১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়, মাত্র চার বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ভারত থেকে খুলনায় এসেছিলাম। সেই থেকে এই মাটিতেই বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, কর্মজীবন আর জীবনের সব আনন্দ-বেদনার গল্প। ঈদ এসেছে, ঈদ গেছে, কিন্তু রয়ে গেছে তার স্মৃতিগুলো, প্রতিটি সময়ের নিজস্ব রঙে রাঙানো। আজ ৮২ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে বুঝি, ঈদ কেবল উৎসব নয়, এটা সময়ের আয়নায় বদলে যাওয়া সমাজ ও জীবনের এক নিঃশব্দ সাক্ষী।
এখনকার ঈদ মানে আলোকসজ্জা, তোরণ আর প্যান্ডেলের জৌলুশ; সেই সময়ের ঈদ ছিল অনেকটাই সাদামাটা, কিন্তু তার আন্তরিকতা ছিল গভীর। খুলনা সার্কিট হাউসে ঈদের প্রধান জামাত হতো, তবে এখনকার মতো উপচে পড়া ভিড় ছিল না। মানুষ নামাজ আদায় করতেন, কোলাকুলি করতেন, একে অপরের খোঁজখবর নিয়ে ঘরে ফিরে যেতেন পরিতৃপ্ত মন নিয়ে। বিশাল আয়োজন না থাকলেও ছিল নির্মল আনন্দ আর সহমর্মিতা। টাউন জামে মসজিদেও হতো বড় জামাত।
ঈদের আরেক চিরচেনা অনুষঙ্গ ছিল সিনেমা দেখা। ঈদের সময় হলে কলকাতা ও পাকিস্তানের নতুন সিনেমা মুক্তি পেত। হলের সামনে লম্বা লাইন পড়ত, টিকিট পাওয়া ছিল ভীষণ কষ্টসাধ্য। এমনকি টিকিট কালোবাজারিও হতো। এক শ্রেণির মানুষের কাছে ঈদটা যেন সিনেমা না দেখলে অপূর্ণই থেকে যেত। আজকের প্রযুক্তিনির্ভর সময়ে যেখানে মুঠোফোনের এক স্পর্শে বিনোদন হাতের মুঠোয়, সেখানে টিকিট পাওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করাটা হয়তো অবিশ্বাস্য মনে হবে।
কোরবানির পশুর হাটের স্মৃতিগুলোও বেশ স্বতন্ত্র। রূপসা নদীর অন্য পারে পূর্বরূপসায়, যেখানে খুলনা থেকে বাগেরহাট ট্রেন যাওয়ার স্টেশন ছিল, সেখানে বসত পশুর হাট। ডুমুরিয়ার শাহপুরের হাটও ছিল বেশ বড়। পাঁচ-ছয় দিন ধরে পশুর বেচাকেনা চলত, শেষ দুই দিন আগে কেনাকাটা জমে উঠত। অবাক করা বিষয় হলো, তখন খুলনা শহরের খুব বেশি মানুষ গরু কোরবানি দিত না, ছাগল কোরবানির চলটাই ছিল বেশি।
আজকাল যেমন বিশাল আকারের গরুগুলো গলায় মালা পরে প্রদর্শিত হয়, সে সময় এমনটা ছিল না। বড় গরু তখন সহজে পাওয়া যেত না, আর রাস্তাঘাটও এত ভালো ছিল না যে হাট থেকে গরু আনা সহজ হবে। তাই গ্রামের দিকে অবস্থাপন্নরা গরু কোরবানি দিলেও শহরে ছাগল কোরবানির চলই ছিল বেশি। আমাদের বাসাতেও ছাগল কোরবানি দেওয়া হতো। কসাইও এত ছিল না তখন, তাই অনেকেই ঈদের দ্বিতীয় দিনে কোরবানি দিতেন। তখন কোরবানির আয়োজন ছিল একান্ত ঘরোয়া। সেদিনের সেই সহজ জীবনযাত্রার সঙ্গে আজকের এই বৈচিত্র্যময় কোরবানি বাজারকে মেলাতে গেলে এক অন্য রকম অনুভূতি হয়।
পোশাক বা আপ্যায়নের ক্ষেত্রেও সে দিনের ঈদ ছিল ভিন্ন। এখনকার ছেলেমেয়েরা যেমন নিজেদের মতো করে বাইরে চলে যায়, আমাদের সময় সেই সাহস ছিল না। কোরবানির পর মাংস নিয়ে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাসায় যেতাম, কখনো তারা জোর করে খাইয়ে দিতেন। আবার কখনো বাসায় কোরবানি দেওয়ার জায়গায় একটা ঝুড়িতে কিছু মাংস নিয়ে বসে থাকতাম, গরিব কেউ এলে সেখান থেকে কিছুটা দিতাম। এখন অনেক কিছুই রয়েছে, কিন্তু সেই আন্তরিকতার ঘনত্বটা যেন ফিকে হয়ে গেছে।
আজকের পয়সার আধিক্য আর জৌলুশ তখন ছিল না। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ছিল সীমিত, প্রতিটা ঘর কমবেশি এক রকম ছিল। সমাজব্যবস্থাটা ছিল অভিভাবকনির্ভর; অভিভাবকেরা যেটা দিতেন, তা-ই পরতে হতো। আবদার করার সুযোগ খুব বেশি ছিল না। যেহেতু রোজার ঈদে সবাই নতুন পোশাক পেত, কোরবানির ঈদে নতুন পোশাক পাওয়ার সম্ভাবনা বেশ কমই থাকত। কোরবানির ঈদে নতুন জামা দেওয়া অভিভাবকদের কাছে অনেকটা বিলাসিতা মনে হতো। ঈদের দিন একটু বিশেষ রান্না হতো, তবে পদের বাহার ছিল না। সাধারণত পোলাও, মাংস। এই সরলতাই হয়তো তখনকার দিনগুলোকে আরও সুন্দর করে তুলেছিল।
ঈদের দিনে নদীতে নৌকাবাইচ হতো, লাঠিখেলা হতো, ষাঁড়ের লড়াই কিংবা দড়ি টানা খেলায় মাতত পাড়া-প্রতিবেশীরা। এখন সেসব আয়োজন হয় খুবই সীমিতভাবে। তখন ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে কার্ড পাঠানোর রীতি ছিল। ঈদের আগে দোকানগুলোয় বাহারি কার্ড বিক্রি হতো। ডাকযোগে পাঠানো হতো কার্ড। ডাকপিয়নের অপেক্ষা করতাম সবাই। মাঝেমধ্যে লোকমারফতও কার্ড আসত। আজ প্রযুক্তির ছোঁয়ায় শুভেচ্ছা পৌঁছে যায় মুহূর্তে; কিন্তু কী যেন হারিয়ে গেছে, শুধু গতিই আছে, গভীরতা নেই।
তখন প্রাচুর্য ছিল না, কিন্তু তবু আনন্দ ছিল গভীর, আন্তরিক। ঈদের মেজাজ ছিল আত্মার, হৃদয়ের। আজ ঈদের আগে বাজারে হঠাৎ দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফন হয়, এক শ্রেণির ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফার লোভে আজ পণ্যের দাম বাড়ায়, উৎসবকে ঘিরে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিপরায়ণদের দৌরাত্ম্য দেখা যায়। কোনো কোনো রাজনীতিক ঈদের নামে প্রচারে মেতে ওঠেন। অনেকেই পশু কোরবানির চেয়ে তার প্রদর্শনী নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। একসময় যেখানে ঈদ ছিল আন্তরিকতার প্রতীক, আজ কোথাও কোথাও তা হয়ে উঠেছে প্রতিযোগিতার মাঠ।
আজ জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে, ঈদের দিনে যাঁদের সঙ্গে হেসেছি, খেয়েছি, মিশেছি—তাঁরা অনেকেই আজ নেই। তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করি।
এই বয়সে এসে বুঝি, ঈদের প্রকৃত আনন্দ ছিল একে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে, ছিল হৃদয়স্পর্শী আন্তরিকতার মধ্যে। সেই ঈদে ছিল না প্রাচুর্য, ছিল না মুঠোফোন, ফেসবুক বা টিভির ঝলমলে অনুষ্ঠান। কিন্তু ছিল ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর অকৃত্রিম সম্পর্কের বন্ধন। আজও ঈদ আসে, আনন্দ বয়ে আনে। কিন্তু পুরোনো দিনের সরল ঈদগুলো থেকে যায়-মনোজগতে, অনুভবের গহিনে; অলক্ষ্যে জ্বলতে থাকা এক উজ্জ্বল আলো হয়ে। লিখেছেন উত্তম মণ্ডল, সাবেক কোষাধ্যক্ষ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
আপনার মতামত জানানঃ