ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ওপর ‘পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ’ কায়েমের চেষ্টা করছে। ফিলিস্তিনে দখলদারত্ব অবসানের কোনো ইচ্ছাই নেই ইসরায়েলের। এনিয়ে চলতি বছরের রমজান মাস থেকে ইসরায়েল–অধিকৃত ফিলিস্তিনের মাটিতে বড় ধরনের উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি সেনাদের হাতে গত বছরের (২০২১) চেয়ে চলতি বছরের (২০২২) প্রথম ছয় মাসে বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বেশি।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনের বরাতে এ তথ্য জানায় ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম জেরুজালেম পোস্ট।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক স্থানীয় কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে নিহত হয়েছিলেন ৪১ জন।
জাতিসংঘ বলছে, ২০২১ সালে ইসরায়েলের সেনাদের হাতে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ছিল ৭৮। আর ২০২০ সালে ২৪ জন।
আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থি এ কাজ করার জন্য প্রতিবেদনে আইডিএফ, বর্ডার পুলিশ এবং পুলিশের মতো ইসরায়েলের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বহু ঘটনায় দেখা গেছে, ইসরায়েলের সেনারা শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা না করে শুরু থেকেই প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে।’
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক স্থানীয় কার্যালয় একটি জটিল নিরাপত্তা পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছে যেখানে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে ১৮ ইসরায়েলি ফিলিস্তিনিদের হামলায় নিহত হয়েছেন। দুই দশক আগে শুরু হওয়া দ্বিতীয় ইন্তিফাদার পর কম সময়ে (মার্চ থেকে মে) এত ইসরায়েলি সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হননি।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে নিহত হয়েছিলেন ৪১ জন।
প্রতিবেদনে ইসরায়েলি সেনাদের হাতে হত্যার শিকার ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে নানা তথ্য দিয়ে এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে।
‘এসব সহিংসতার ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার অভাব ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে। এ ধরনের দায়মুক্তি নতুন করে আরও সহিংসতা ঘটানোর অনুমোদন দেয়’, যোগ করা হয় প্রতিবেদনে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক স্থানীয় কার্যালয় থেকে বলা হয়, এসব ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে যাদেরই সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। দায়মুক্তির এ সংস্কৃতির অবসান হওয়া উচিত এখনই।
চলতি বছরের শুরু থেকেই ইসরায়েল ও অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, পহেলা জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ৫১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। বিপরীতে ফিলিস্তিনিদের হামলায় ইসরায়েলের ১৯ জন নিহত হয়েছেন।
গত মে মাসে অধিকৃত পশ্চিত তীরের জেনিন শহরে সামরিক অভিযানের সংবাদ সংগ্রহকালে আল-জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে মুসলিমদের পবিত্র রমজান মাসজুড়ে অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ফিলিস্তিনি মুসলিমদের ওপর একের পর এক হামলা চালানো হয়েছে। এতে অসংখ্য ফিলিস্তিনি আহত হন।
প্রতিদিন গড়ে অন্তত দু’জন ফিলিস্তিনি শিশুকে ধরে নিয়ে যায় ইসরায়েলি সৈন্যরা৷ জেলে পুরে চালায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন৷ প্রায় ৭ হাজার শিশুর ওপর এমন অমানবিক নির্যাতনের তথ্য জানিয়েছিল জাতিসংঘ৷
সারা বিশ্বে শিশুরা যেখানে গড়ে ৬ দশমিক ৮ থেকে ১২ দশমিক ২ শতাংশ পিটিএসডিতে (পোস্ট ট্রমাটিক ডিজঅর্ডার) ভুগছে, সেখানে ফিলিস্তিনি শিশুদের মধ্যে এ হার ৩৪ দশমিক ১ থেকে ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ।
বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে ইসরায়েলি সেনাদের আগ্রাসনের ঘটনা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা ও ভীতির বোধ জন্ম নিচ্ছে। ঘর যেখানে তাদের নিশ্চয়তা আর আনন্দের উৎস হওয়ার কথা, তার বদলে ভীতি তাদের তাড়া করে ফিরছে। এর ফলাফল হচ্ছে, শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে আগ্রহ হারাচ্ছে, তারা চুপচাপ, বিষণ্ন কিংবা খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে।
এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালে প্রতি সপ্তাহে ইসরায়েল একজনের বেশি শিশুকে হত্যা করেছে। এর আগের এক দুঃখজনক সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছিল, ২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ১৪ বছর গড়ে প্রতি তিন দিনে একটি ফিলিস্তিনি শিশুকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে অধিকৃত পশ্চিম তীরের ৭৯ শতাংশ স্থাপনা নিজেদের দখলে নিয়েছে ইসরায়েল। পূর্ব জেরুজালেমের ২০ শতাংশ স্থাপনা তাদের কবজায়। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয়বিষয়ক কার্যালয়ের (ওসিএইচএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ফিলিস্তিনি মালিকানাধীন অন্তত ৮ হাজার ৪১৩টি স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। এতে সর্বস্ব খুইয়ে পথে বসেছেন প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ফিলিস্তিনি। বিপরীতে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে এ পর্যন্ত সাড়ে সাত লাখ ইহুদিকে বসতি গড়ে দিয়েছে ইসরায়েল সরকার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হলোকাস্টের নির্মমতাও যেন ছাপিয়ে গেছে ইসরায়েলের বর্বর কর্মকাণ্ডে; নাৎসিদের থেকেও অধিক জিঘাংসু হয়ে উঠেছে জায়নবাদীরা। তাদের একপেশে নির্বিচার হামলা, সর্বাত্মক অবরোধ–আগ্রাসনে অকাল আর অপঘাত মৃত্যু যেন ফিলিস্তিনিদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে যে ‘নাকবা’ নেমে এসেছে ফিলিস্তিনি ভূমিতে, তার তাণ্ডবশক্তির নিচে মানবিকতার পদদলন আর কত দিন? আর কত দিনই বা তা ‘চুপচাপ’ চেয়ে চেয়ে দেখবে বাকি বিশ্ব? আর কত রক্তমূল্য পরিশোধে মানবমুক্তির পয়গাম পৌঁছাবে ফিলিস্তিনি ভূমিতে?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪৫
আপনার মতামত জানানঃ