বিশ্ববাজারে দাম আবার চড়া। তাই খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে না সরকার। দেশে কমে গেছে গ্যাসের সরবরাহ। রান্নার চুলা থেকে শিল্পের চাকাও ভুগছে গ্যাসসংকটে। কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বেড়েছে লোডশেডিং।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় কয়েকদিন ধরে লোডশেডিং বেড়েছে। লোডশেডিং বেড়েছে রাজধানী এবং আশপাশের জেলাগুলোতেও। হঠাৎ লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। ফলে লোড ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, গ্যাসের স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে অনেক জায়গাতেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুনরায় স্বাভাবিক হবে। যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের উচ্চমূল্য ও সরবরাহ সব দেশকেই সমস্যায় ফেলেছে। বিষয়টি আমাদেরকেও বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। সাময়িক অসুবিধার জন্য সম্মানিত গ্রাহকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জ্বালানি খাত প্রায় আমদানিনির্ভর। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পুরোপুরি আমদানি করে চলে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে আমদানি করা লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) দিয়ে চালানো হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস এবং তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় সরকার ব্যায়বহুল তেল-গ্যাস আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছে। স্পট মার্কেট থেকে যে গ্যাস আমদানি করা হতো, সেখানে লাগাম টানা হয়েছে। তেল আমদানির ক্ষেত্রেও বিপিসি হিমশিম খাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে অর্থ সংকটের দিকে যাচ্ছে বিপিসি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসি বলছে, বিদেশ থেকে তেল আমদানি করে দেশের বাজারে সরবরাহ করে প্রতিদিন তাদের ১০৮ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী তিন মাসের মধ্যে বিপিসির দেউলিয়া হওয়ার অবস্থা হবে। ফলে দাম সমন্বয়ের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেও বারবার বলা হচ্ছে দাম সমন্বয় করা হবে। প্রতি লিটার জ্বালানি তেলে ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। তারা বলছেন, এলএনজি আমদানি কমায় গ্যাস সরবরাহ গত কয়েক দিনে ৩০ শতাংশ কমে গেছে। জ্বালানি তেলের দামও চড়া। তাই তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ তেল–গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুট। সাধারণত গড়ে ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো সরবরাহ করা হয়। দুই দিন ধরে সরবরাহ করা হচ্ছে দিনে ২৭৫ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট করে।
সূত্র মতে, কিছু দিন ধরেই ধাপে ধাপে কমানো হচ্ছিল সরবরাহ। এলএনজি কেনা না হলে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই আপাতত। বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম ৩৮ ডলার ছাড়িয়েছে। সর্বশেষ কেনা হয়েছিল ২৫ ডলারে।
সরকারিভাবে এলএনজি আমদানি করে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। সরকারি এ কোম্পানির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, এলএনজি কেনার কাজটি তারা করলেও সিদ্ধান্ত দেয় পেট্রোবাংলা ও সরকার। গত মাসে স্পট থেকে তিনটি কার্গো (জাহাজ) এসেছে। দিনে ৭৫ থেকে ৮০ কোটি ঘনফুট করে সরবরাহ করা হয়েছে। এ মাসে কয়েক দিন ধরে ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে। মূলত, গতকাল রোববার থেকে সরবরাহ এমন কমে যায়। এখন শুধু দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ওমান ও কাতার থেকে আসা এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বই সাশ্রয়ী হচ্ছে। এলএনজির দাম কমলে স্পট থেকে আমদানি করা হবে। এখন দেশীয় উৎস থেকে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়া রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকেরা তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানিতে অভিযোগ করছেন দুই দিন ধরে। তিতাস সূত্র বলছে, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, বারিধারা, বাড্ডা ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় একদমই গ্যাস পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা। আর কাঁঠালবাগান, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ বেশ কিছু এলাকায় গ্যাসের চাপ কমে গেছে। কোনোরকমে রান্নার চুলা জ্বলছে এসব এলাকায়। সাভার, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ এলাকার শিল্পকারখানাও গ্যাসের অভাবে উৎপাদন করতে পারছে না বলে অভিযোগ আসছে।
এদিকে গ্যাসের অভাবে কমে গেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। চাহিদা মতো বিদ্যুৎ পাচ্ছে না বিতরণ কোম্পানি। বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে দিনে গড়ে দুই হাজার মেগাওয়াট। গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অধিকাংশই বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
তাই গতকাল থেকে সারা দেশে লোডশেডিং বাড়ানো হয়েছে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দিনে চার থেকে পাঁচবার লোডশেডিং হচ্ছে। কোথাও কয়েক ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা।
আজও চাহিদার চেয়ে ৩০০ মেগাওয়াট কম সরবরাহ পাচ্ছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। দিনে এ সংস্থার চাহিদা ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট, সরবরাহ পাচ্ছে ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। রাজধানীর আরেকটি বিতরণ কোম্পানি ডেসকোর সরবারহ কমেছে দিনে ১৫০ মেগাওয়াট। এ সংস্থার দিনে চাহিদা ১ হাজার মেগাওয়াট, পাচ্ছেন ৮৫০ মেগাওয়াট।
ডিপিডিসির ব্যবস্থপনা পরিচালক (এমডি) বিকাশ দেওয়ান বলেন, গ্রাহকের ভোগান্তি কমাতে বিভিন্ন এলাকায় ভাগাভাগি করে লোডশেডিং করা হচ্ছে। জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। গতকাল থেকে এ পরিস্থিতি চলছে বলে জানান তিনি।
তবে সবচেয়ে বেশি খারাপ পরিস্থিতি ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকায়। দেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) কর্মকর্তাদের সূত্র মতে এটি জানা গেছে। তারা বলছেন, দেশের প্রায় ৫৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আরইবি। গতকাল সরবরাহ কমেছে ৮৫১ মেগাওয়াট। সারা দেশেই লোডশেডিং করতে হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোয়।
রংপুর, ঠাকুরগাও, রাজশাহী, বগুড়াতেও বেড়েছে লোডশেডিং। সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুরেও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুত পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা। বগুড়ার গ্রাহক আদনান আজাদ অভিযোগ করেছেন, দিনে ১৪ ঘণ্টার মতো লোডশেডিং হচ্ছে বগুড়ায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২২
আপনার মতামত জানানঃ