দেশে সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় চলতি বছর এখন (৩০ জুন) পর্যন্ত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ৭৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১৩ জন ধর্ষণ, ১০ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ধর্ষণের পর তিন জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট।
সংগঠনটির মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিকের দাবি, এই সময়ে আরও ৬২০ জনকে হত্যার হুমকি, ১৪৫ জনকে হত্যার চেষ্টা, ১৮৩ জনকে জখম-আহত ও ৩২ জন নিখোঁজ হয়েছেন।
শনিবার (২ জুলাই) সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি নসরুল হামিদ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু মহাজোটের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্যে এসব তথ্য জানান তিনি। এ সময় গত ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ২৭ কোটি ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা চাঁদাবাজি এবং ১৫৬টি পরিবার ও মন্দির লুট হয়েছে বলেও দাবি করা হয়।
এসব তথ্য কিসের ভিত্তিতে প্রকাশ করা হচ্ছে জানতে চাইলে গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের একটি নিজস্ব গবেষণা সেল রয়েছে, মূলত সারাদেশে আমাদের যে কমিটি রয়েছে; সেগুলোর মাধ্যমে এ তথ্যগুলো পাওয়া। আমরা সারাদেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্য সন্নিবেশিত করে প্রকাশ করছি।’
সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রক্ষায় সহিংসতা ও নির্যাতন নিরোধ, গণতন্ত্র অর্থবহ করতে তাদের প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিতের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে ৬০টি সংরক্ষিত আসন এবং পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা ’পুনঃপ্রতিষ্ঠা’র দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট। এ ছাড়া একটি পৃথক সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও প্রতিষ্ঠার দাবি করেছে সংগঠনটি।
গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিকের দাবি, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৪৬৮টি বসতবাড়ি হামলা ভাঙচুর ও লুটপাট, ৩৪৩টি অগ্নিসংযোগ, ৯৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ২ হাজার ১৫৯ একর ৩৬ শতাংশ ভূমি দখল এবং ৪১৯ একর ৬৩ শতাংশ দখলের তৎপরতা চালানো হয়েছে। ঘরবাড়ি দখল হয়েছে ১৭টি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ২৯টি, মন্দিরের জমি দখল ২৯টি, বসতবাড়ি উচ্ছেদ হয়েছে ১৩২টি। এ ছাড়া ৭১৭টি পরিবারকে উচ্ছেদের চেষ্টা, ৮ হাজার ৯৪৩টি পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি, ১৫৪টি পরিবারকে দেশত্যাগের বাধ্যকরণ, ৩ হাজার ৮৯৭টি পরিবারকে দেশত্যাগে হুমকির শিকার এবং ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৯টি পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে।
তিনি আরও দাবি করেন, চলতি বছরে ৫০১টি সংঘবদ্ধ হামলা, ৫৬টি মন্দিরে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ, ২১৯টি প্রতিমা ভাংচুর, ৫০টি প্রতিমা চুরি, ৭৭ জনকে অপহরণ, ১৫ জনকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৩ জন ধর্ষণ, ১০ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ধর্ষণের পর তিন জনকে হত্যা, ১৯ জনকে ধর্ষণচেষ্টা, ৯৫ জনকে ধর্মান্তরিত করা, ২১ জনকে ধর্মান্তরের চেষ্টা, ৬৩টি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনাও ঘটেছে দেশে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৩ জন ধর্ষণ, ১০ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ধর্ষণের পর তিন জনকে হত্যা, ১৯ জনকে ধর্ষণচেষ্টা, ৯৫ জনকে ধর্মান্তরিত করা, ২১ জনকে ধর্মান্তরের চেষ্টা, ৬৩টি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনাও ঘটেছে দেশে।
এ ছাড়াও মিথ্যা মামলায় সম্প্রদায়টির ৯৬ জনকে গ্রেফতার, বরখাস্ত, চাকরিচ্যুত ও জেল-জরিমানা, ৮০২টি পরিবারকে অবরুদ্ধ করা, ৫৭টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অপবিত্রকরণ, ৬০টি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে বাধা, ১০০ জনকে ধর্মীয় নিষিদ্ধ গরুর মাংস খাওয়ানোর ঘটনা ঘটেছে। মোট ৬৩৮টি আলাদা ঘটনা ঘটনায় ক্ষতি হয়েছে ১৫২ কোটি ৩৫ লাখ ৫৫ হাজার টাকার।
গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, ‘এসব ঘটনার ধারাবাহিকতায় প্রমাণিত হয় যে, এদেশে হিন্দুদের বসবাস দিনকে দিন কঠিনতর হচ্ছে।’
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় স্বস্তিতে নেই দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটছে। নির্যাতন নিপীড়নে অতিষ্ঠ হিন্দুরা দুর্বিষহ অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে হিন্দু শিক্ষকদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত করার অভিনব কৌশল নতুন উপসর্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার দৌরাত্ম দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। পুলিশ ও প্রশাসনের উপস্থিতিতে ও সক্রিয় সহযোগিতায় শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানোসহ হেনস্তা করা হচ্ছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, সাভারসহ বিভিন্ন জায়গায় বিরামহীনভাবে প্রতিনিয়ত একটার একটা ঘটনা ঘটেই চলেছে।
সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মদদেই হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের ওপর এসবের দায় চাপিয়ে তারা আবারও ক্ষমতায় আসতে চায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের কারণে মানুষের মননে সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এই সরকারের শাসনামলেই পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ, কওমি জননী উপাধি দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের তৈরি করা জমিতেই এখন সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের চাষ হচ্ছে।
তারা বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের উসকানি দিতে দেখা গেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই বেড়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তির পাহারাদার। এদের দিয়ে প্রগতিশীলতা রক্ষা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া যাবে না। সারা দেশে অব্যাহত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ করা, এর সঙ্গে জড়িত ও মদদদাতাদের গ্রেপ্তার-বিচার করা এবং হামলা-লুটপাটের দায় সরকার ও পুলিশ-প্রশাসনকে নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, এ দেশের সকল ধর্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য। এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি যুদ্ধ করে অর্জন করা। সেই মাটির অধিকার আমাদের সকলের। কেবল ধর্মের কারণে সেই অধিকারবোধ নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। যে কোনো মূল্যে এই ঐক্যের বোধ জাগ্রত রাখতে হবে। উন্নয়নের প্রকৃত সোপান সেখানেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৫
আপনার মতামত জানানঃ