নারী নির্যাতনে শীর্ষস্থানীয় বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে শিশু নির্যাতনের চিত্র উঠে আসছে। এর বাইরেও নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। নিরপরাধ শিশুরা শিকার হচ্ছে খুন, ধর্ষণ কিংবা ভয়াবহ নির্যাতনের। এসব ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দৃষ্টান্ত খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। অনেক সময় ভোক্তভোগী আইনের আশ্রয় নিলেও অপরাধী ফাঁকফোকরে ছাড়া পেয়ে যায়। করোনা মহামারিতে মানুষ যখন বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে, তখনও নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ নেই বরং বেড়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদন মতে, চলতি বছরের জুন মাসে ২৯৮ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৬ জন। এর মধ্যে ৯ জন কন্যা ও ১০ জন নারীসহ ১৯ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদে সংরক্ষিত ১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ তথ্য জানা গেছে। বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) মহিলা পরিষদের এক প্রতিবেদনে ওই তথ্য প্রকাশ করা হয়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ২০২২ সালের জুন মাসে মোট ২৯৮ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১২৬ জন কন্যা এবং ১৭২ জন নারী। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৬ জন। তার মধ্যে ৯ জন কন্যা ও ১০ জন নারীসহ ১৯ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এক কন্যা ও এক নারী ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন।
৩৮ কন্যা ও ১৬ নারীসহ ৫৪ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং এক কন্যা ও এক নারী ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন।
এছাড়াও ১৪ কন্যা শিশুসহ ২১ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ৮ জন শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন, এর মধ্যে পাঁচজনই কন্যা-শিশু।
১১ জন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৮ কন্যা। এসিডদগ্ধের শিকার হয়েছে ৩ জন। ৩ জনের অগ্নিদগ্ধের কারণে মৃত্যু হয়েছে।
২০২২ সালের জুন মাসে মোট ২৯৮ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১২৬ জন কন্যা এবং ১৭২ জন নারী।
ছয় কন্যা অপহরণের ঘটনার শিকার হয়েছেন। নারী ও কন্যা পাচারের ঘটনা ঘটেছে ১৩টি। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৪ জন, এর মধ্যে ৫ জনকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে।
শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২০ জন। এর মধ্যে দুই কন্যা। গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার এক কন্যা-শিশু। ১২ জন উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১১ জনই কন্যা-শিশু। এছাড়াও এক কন্যা উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছে।
বিভিন্ন কারণে সাত কন্যাসহ ৪২ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও ৭ জন নারীকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। পাঁচ কন্যাসহ ১৯ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। তিন কন্যাসহ ১৭ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে দুই নারী আত্মহত্যার প্ররোচনার শিকার হয়েছেন।
এছাড়াও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এক কন্যা-শিশু। ফতোয়ার ঘটনার শিকার হয়েছে একজন। চার কন্যাসহ সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছে পাঁচজন। বাল্যবিবাহ চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ৭টি। এক কন্যা শিশুর জোরপূর্বক বিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও ৯ জন বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমরা কোভিড-১৯ মহামারির চেয়েও ভয়ংকর, নিষ্ঠুর ও বর্বর মহামারি নারী ও শিশুদের ওপর যৌনসহিংসতা, ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। বিগত কয়েক বছর ধরে যৌন সহিংসতার মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নির্যাতনের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর প্রতি নৃসংসতার ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত করা সম্ভব হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয় না। সেক্ষেত্রে পরিবার থেকে প্রতিটি প্রজন্ম শিখছে মেয়েরা মানুষ নয়, তারা শুধু ব্যবহারের জন্য। এভাবে পরিবার থেকেই মূলত নারীর প্রতি অসম্মানের শুরু। এতে বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতনের হার। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের কথা বলছে রাষ্ট্র। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা নারীদের সম্মানের জায়গায় তুলে ধরতে পারছি না।’
তারা বলেন, ‘পরিবার থেকেই নারীদের সম্মান দেওয়ার শিক্ষাটা জরুরি। পাশাপাশি আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় যা রয়েছে তা একপ্রকার ইঁদুর দৌড়ের মতো। আমরা শুধু দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। মানবিক শিক্ষা না শিখে ডিগ্রির পেছনে দৌড়াচ্ছি। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানবিক শিক্ষা শুরু করা দরকার।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২১
আপনার মতামত জানানঃ