রোববার সকালে এক অনুষ্ঠানে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এবারের বন্যাটা একটু বেশিই ব্যাপক হারে এসেছে। প্রতিনিয়ত খবর রাখছি। বন্যার বিপদ মোকাবিলার সব প্রস্তুতি আছে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ বিভাগ, রংপুর বিভাগেও বন্যার সম্ভাবনা আছে। সেটা আগে থেকেই সতর্কতা আমরা নিচ্ছি এবং সেই ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি। পানি নিষ্কাশনের জন্য যা যা করণীয় আমরা সেটাও করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী এবারের বন্যাকে ‘একটু বেশিই ব্যাপক’ বললেও, সারা দেশে বন্যায় গত ১৭ মে থেকে এখন পর্যন্ত ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে সিলেট বিভাগে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগে।
তবে জেলাভিত্তিক হিসাব করলে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে সিলেটে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে সুনামগঞ্জ ও ময়মনসিংহে।
অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে মঙ্গলবার বিকেলে পাঠানো বন্যাবিষয়ক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
সারা দেশে নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এতে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি পানিতে ডুবে এবং ভেসে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে।
এই বন্যায় সিলেট অঞ্চলে ২০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
গত মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহেও বৃহত্তর সিলেট এবং ময়মনসিংহের নেত্রকোণা ও শেরপুরে বন্যা দেখা দেয়। সে সময়ও বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়। রংপুর বিভাগেও কয়েকজন মারা যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ১৭ মে থেকে ২১ জুন পর্যন্ত বন্যায় রংপুর বিভাগে তিনজন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১৫ জন এবং সিলেট বিভাগে ১৮ জনসহ মোট ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পানিতে ডুবে মারা গেছে ১৭ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২ জন মারা গেছে বজ্রপাতে। একজনের মৃত্যু হয়েছে সাপের কামড়ে। অন্য নানা কারণে মৃত্যু হয়েছে আরও ৬ জনের।
জেলাভিত্তিক মারা যাওয়া তালিকার শীর্ষে রয়েছে সিলেট। ১৭ মে থেকে ২১ জুনের মধ্যে সিলেট জেলায় ১০ জনের মৃত্যু হয়।
সুনামগঞ্জ ও ময়মনসিংহে মৃত্যু হয়েছে সমান সংখ্যায় পাঁচজন করে। এ ছাড়া নেত্রকোণায় চারজন, মৌলভীবাজার, জামালপুর ও শেরপুরে তিনজন করে এবং কুড়িগ্রামে দুইজন ও লালমনিরহাটে একজন মারা গেছে।
আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে তীব্র খাদ্য সংকট
সিলেটের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় পাঁচদিন ধরে আটকে আছেন কয়েক লাখ মানুষ। অধিকাংশ ভবনের নিচতলা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দুই ও তিনতলায় আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে। এ অবস্থায় ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়েছেন সিলেটের প্রায় ২০ লক্ষাধিক মানুষ। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে থাকা প্রায় আড়াই লাখ মানুষ রয়েছেন তীব্র খাবার সংকটে।
এখনো মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রের খোঁজে আছে। সেনাবাহিনী তাদের উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ এবং চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তবে তা প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রতুল।
এর মধ্যে নেই বিদ্যুৎ, মুঠোফোনগুলো বন্ধ। এমন ভুতুড়ে পরিস্থিতিতে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রায় ৫০০ আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সরকারি ও বেসরকারীভাবে দেওয়া ত্রাণ অপ্রতুল বলছেন বন্যাদুর্গতরা। খাদ্য সংকটে অভুক্ত রয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা ৩১ হাজার গৃহপালিত পশুও।
এদিকে বন্যার পানি তেমন কমছে না। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে আজ সকাল ৬টা পর্যন্ত সুরমা নদীর সিলেট সদর পয়েন্টে পানি কমেছে মাত্র দশমিক ১ সেন্টিমিটার। আর একই সময়ে সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসীদ পয়েন্ট কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়েছে দশমিক ৯ সেন্টিমিটার। বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হওয়ায় আতঙ্কে আছেন লোকজন। এছাড়া নগরের ফাঁকা বাসাবাড়িতে চুরি ও ডাকাতি বেড়েছে।
এমন অবস্থায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন নগরের বাসিন্দারা। এখন আর নগরে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র খালি নেই। সবজায়গায় লোকজনে টই-টম্বুর। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় বন্যাদুর্গতরা চাইলেই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারছেন না। অতিরিক্ত পানি থাকায় তারা বাসাবাড়ির সিঁড়িতে এমনকি বাসার ছাদেও ত্রি-পল টানিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
কেউ কেউ আশ্রয় খুঁজছেন আত্মীয়স্বজন আর পরিচিতজনদের বাড়িতে। বহুতল ভবনের নিচতলার বাসিন্দারা উঠে যাচ্ছেন দোতলা, তিনতলায়। আর যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তারা ছুটছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। কিন্তু পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা না থাকায় আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দারা ভুগছেন খাদ্য সংকটে। নিজেদের জমানো সঞ্চয় আর মানুষের সহায়তাই এখন তাদের ভরসা।
স্থানীয়রা জানান, টানা বৃষ্টি ও জমে থাকা বন্যার পানির কারণে ঘর থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ায় ত্রাণ কার্যক্রমও খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। অনেকের ঘরে চাল-সবজি থাকলেও সেগুলো রান্না করে খাওয়ার মতো ব্যবস্থা নেই। বেশিরভাগ ঘরবাড়িতে পানির কারণে আগুন জ্বালানের ন্যূনতম সুযোগও নেই।
বর্তমান পরিস্থিতি কি?
দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর ৭৬টি পয়েন্টে পানির স্তর বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২৯টি পয়েন্টে কমেছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি)।
সোমবার (২০ জুন) এক বুলেটিনে বলা হয়, নদ-নদীর ১০৯টি পয়েন্টের মধ্যে চারটি পয়েন্টে পানির স্তর স্থিতিশীল রয়েছে এবং ১৯টি পয়েন্টে পানির স্তর বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ব্রহ্মপুত্রের নুনখাওয়া, হাতিয়া, চিলমারী ও ফুলছড়ি, যমুনার বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি, কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ ও পোড়াবাড়ি, কুড়িগ্রামের ধরলা, গাইবান্ধার ঘাগোট, সুরমার কানাইঘাট, সিলেট ও সুনামগঞ্জ, কুশিয়ারার অমলশিদ, সচলা, খোয়াইয়ের বল্লা, পুরাতন সুরমার দিরাই এবং সোমেশ্বরীর কলমাকান্দার পানি বিপদসীমার যথাক্রমে ২৩ সেমি, ১০২ সেমি, ৫২ সেমি, ৫১ সেমি, ৪৭ সেমি, ৫১ সেমি, ৪৩ সেমি, ৩৪ সেমি, ২০ সেমি, ৪৪ সেমি, ৩২ সেমি, ১১৫ সেমি, ৫৫ সেমি, ৪০ সেমি, ১৮৪ সেমি, ৬৩ সেমি, ১১৫ সেমি, ১০২ সেমি এবং ৯২ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন জেলার কয়েকটি পয়েন্টে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে বুলেটিনে উল্লেখ করা হয়।
চট্টগ্রামে ২৪২ মিলিমিটার (মিমি), পরশুরামে (ফেনী) ১৭৫ মিমি, রাঙামাটিতে ১৫৫ মিমি, টেকনাফে ১৪৬ মিমি, কুমিল্লায় ১০০ মিমি, নারায়ণহাটে (চট্টগ্রামে ৯২ মিমি), বান্দরবানে ৯৫ মিমি, বান্দরবানে ৯৫ মিমি (মিমি), পাঁচপুকুরিয়ায় (চট্টগ্রাম) ৯০ মিমি এবং কক্সবাজারে ৮৮ মিমি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
চলমান বন্যায় নেত্রকোণার ১০ উপজেলায় মৎস্য, প্রাণিসম্পদ ও কৃষিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলার অন্তত ২৫ হাজার বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পুকুরের মাছ বানের জলে ভেসে গেছে। ২২৩টি গবাদিপশুর খামার এবং ৪৪২টি হাঁস-মুরগির খামার প্লাবিত হয়েছে।
এ ছাড়া পানিতে নিমজ্জিত হয়ে নষ্ট হয়েছে ১ হাজার ৯১ হেক্টর জমির ধান, পাট ও সবজিজাতীয় ফসল।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহজাহান কবির নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, বন্যায় দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, মোহনগঞ্জ ও বারহাট্টাসহ ১০ উপজেলার প্রায় ১১ হাজার টন মাছ ভেসে গেছে, যার আর্থিক মূল্য ১০০ কোটি টাকার বেশি।
মোহনগঞ্জ উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এ উপজেলার ২ হাজার ৪০টি বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭০ লাখ টাকা। খালিয়াজুরীতেও পুকুর ডুবেছে ৪১৪টি।
কলমাকান্দার নাজিরপুর এলাকার মৎস্যচাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার তিনটি পুকুরে প্রায় ১২ লাখ টাকার মাছ ছিল। এক রাতের বন্যায় সব ভেসে গেছে। এত বড় বন্যা হবে, তা এক দিন আগেও টের পাইনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার সমস্ত পুঁজি মাছ চাষে বিনিয়োগ করেছিলাম। সব শেষ হয়ে গেছে।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. শহীদুল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বন্যায় ১০ উপজেলার ২২৩টি গরু-ছাগলের খামার এবং ৪৪২টি হাঁস-মুরগির খামার প্লাবিত হয়েছে। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ৪ কোটি টাকা।
‘এ ছাড়া ২১ লাখ টাকার দানাদার পশুখাদ্য, ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার খড় নষ্ট হয়েছে। চারণভূমি প্লাবিত হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার একর। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭ কোটি টাকা।’
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘ধানের খড়ের পুঞ্জি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় হাওরাঞ্চলের কৃষকরা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়বেন। কারণ বর্ষার পানি না কমা পর্যন্ত তাদের গবাদিপশুকে বাজার থেকে খাবার কিনে খাওয়াতে হবে।’
আসন্ন কোরবানির পশুর হাটেও বন্যার প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘বাড়িঘরে পানি এবং খাদ্যসংকটের কারণে অনেকে গবাদিপশু বাজারে সস্তায় বেচে দিতে পারেন। তাদের বেচে দেয়া গবাদিপশু মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে চলে যেতে পারে। এ কারণে আগামী কোরবানির পশুর হাট তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
‘এ ছাড়া যারা গবাদিপশু মোটাতাজাকরণের ব্যবসা করেন, তারাও ক্ষতির মুখে পড়বেন। কারণ পর্যাপ্ত খাবার না পেলে পশুর স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাবে। এতে দাম কম পাবেন তারা’ বলেন তিনি।
খালিয়াজুরীর বলরামপুর গ্রামের হাঁস খামারি রইছ মিয়া বলেন, ‘আমার খামারে প্রায় ৪০০ হাঁস আছে। এগুলোকে আগে হাওরের পানিতে ছেড়ে দিয়ে প্রাকৃতিক খাবার খাওয়াতাম। এখন বন্যা পরিস্থিতির কারণে ছাড়তে পারছি না। খামারে রেখে ধান খাওয়াতে হচ্ছে।
‘এক মণ ধান কিনতে হচ্ছে ৭৫০ টাকায়। প্রাকৃতিক খাবারের অভাবে ডিম উৎপাদনও কমে গেছে। এর ওপর হাঁসের রোগবালাইয়েরও ভয় আছে।’
মোহনগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাখাওয়াত হোসেন জানান, তার উপজেলার ৩ হেক্টর জমির আউশ ধান, ১০০ হেক্টর জমির পাট এবং ৫০ হেক্টর জমির সবজি সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতির আর্থিক মূল্য প্রায় ২৫ লাখ টাকা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) শাহজাহান সিরাজ বলেন, ‘এবারের বন্যায় ১০ উপজেলার ৫৬৪ হেক্টর জমির আউশ ধান, ১৭০ হেক্টর জমির পাট এবং ৩৫৭ হেক্টর জমির শাকসবজি নষ্ট হয়েছে। এতে উৎপাদনে প্রভাব পড়ার পাশাপাশি কৃষকরাও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন।’
এসডব্লিউ/এসএস/২১২২
আপনার মতামত জানানঃ