শ্রীলঙ্কায় গ্যাস, জ্বালানি, ওষুধ এবং খাদ্যের ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। এনিয়ে দেশটিতে লাগাতার বিক্ষোভ চলছে।
এদিকে নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডুতে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। দেশটির সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের এই তথ্য জানিয়েছেন।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ঘিরে দেশটির জনগণের অসন্তোষের লক্ষণ এই বিক্ষোভ। মঙ্গলবার কাঠমাণ্ডুর বিক্ষোভে কয়েকশ শিক্ষার্থী অংশ নেন।
কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সোমবার বিকালে প্রধান বিরোধীদল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির (ঐক্যবদ্ধ মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) ছাত্র সংগঠন অল নেপাল ন্যাশনাল ফ্রি স্টুডেন্ট ইউনিয়নের (এএনএনএফএসইউ) প্রায় ১০০ বিক্ষোভকারীকে কাঠমাণ্ডুতে সমাবেশ করতে বাধা দেওয়ার পর তারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতিতে নেপালজুড়ে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে আর এই প্রতিবাদ তারই একটি লক্ষণ, বলছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি কোম্পানি নেপাল অয়েল কর্পোরেশন (এনওসি) সোমবার প্রতি লিটার পেট্রলের মূল্য ১২ শতাংশ ও ডিজেলের মূল্য ১৬ শতাংশ বাড়িয়েছে, এতে সব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তা দিনেশ মাইনালি জানিয়েছেন, বিক্ষোভকারীরা পুলিশের দিকে পাথর ছুড়েছে ও পুলিশের একটি গাড়ি ভাংচুর করেছে, তবে কেউ আহত হয়নি এবং কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়নি।
মূল্য বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে বিক্ষোভকারী গিরিশ থাগুন্না রয়টার্সকে বলেন, ‘এটা সরকারের নিছক দায়িত্বজ্ঞানহীন একটি কাজ। এটি ভুল এবং অবিলম্বে প্রত্যাহার করা উচিত’।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলো জানিয়েছে, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির পর গণপরিবহন ও মালবাহী গাড়ির ভাড়া ৭ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ঘিরে দেশটির জনগণের অসন্তোষের লক্ষণ এই বিক্ষোভ। মঙ্গলবার কাঠমাণ্ডুর বিক্ষোভে কয়েকশ শিক্ষার্থী অংশ নেন।
নেপালের ২ কোটি ৯০ লাখ মানুষ ক্রমবর্ধমান খাদ্য ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধির মুখোমুখি হয়েছে। আর এতে সামাজিক বিশৃঙ্খলার ঝুঁকিও বেড়েছে। দেশটিতে খুচরা পণ্যের বার্ষিক মূল্যস্ফীতি মে মাসের মাঝামাঝিতে গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশটির সরবরাহ মন্ত্রী দিলেন্দ্র প্রসাদ বাডু সোমবার একটি সংসদীয় কমিটিকে বলেছেন, বিশ্বজুড়ে তেলের দাম বৃদ্ধি এবং আমদানি করতে গিয়ে এনওসির ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ায় সহায়তার জন্য এই দাম বৃদ্ধির দরকার ছিল।
এদিকে শ্রীলঙ্কায় গ্যাস, জ্বালানি, ওষুধ এবং খাদ্যের ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ সব স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারি অফিসগুলোতে নামমাত্র জনবল উপস্থিত থাকার কথা বলেছে। এসব করে সেখানে জ্বালানি সাশ্রয় করতে চাইছে সরকার। একই সঙ্গে সোমবার থেকে দু’সপ্তাহের জন্য আইএমএফ প্রতিনিধিদের সঙ্গে বেইলআউট বা সংকট উদ্ধারে আলোচনা শুরু করেছেন সরকারি প্রতিনিধিরা।
রাজধানী কলম্বোতে এই বৈঠক শুরুর দিনেই খাদ্য, জ্বালানি, গ্যাস, ওষুধ সংকটের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে ইন্টার ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ফেডারেশন (আইইউএসএফ)। লিপটন সার্কাস থেকে শুরু হয়ে ফোর্ট রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে শেষ হয় এই বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভ থেকে স্বস্তি দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে সরকারের কাছে। গ্যালে ফেস গ্রিনে প্রতিবাদী ‘গোটাগোগামা’র অনেক নেতাকর্মীও এতে যোগ দিয়েছিলেন।
জ্বালানি সংরক্ষণে সপ্তাহের শুরুতে দেশটিতে সাপ্তাহিক ছুটি এক দিন বাড়িয়ে তিন দিন করা হয়। এ সত্ত্বেও পেট্রল স্টেশনগুলোয় দীর্ঘ লাইন দিয়ে মানুষকে অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়। অনেক মোটরসাইকেলচালকের দাবি, পেট্রলের জন্য কয়েক দিন ধরে অপেক্ষায় আছেন তারা।
পেট্রল ও ডিজেলের তীব্র সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সব বিভাগ, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে কাল সোমবার থেকে সীমিত পরিসরে যান চলাচলের নির্দেশ দিয়েছে।
ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কায় এখন প্রয়োজনীয় ওষুধের অভাব দেখা দিয়েছে। দেশটির প্রায় সব হাসপাতালেই জীবন রক্ষাকারী ওষুধ না থাকায় গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা থেমে আছে।
দেশটির হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রসমূহে প্রয়োজনীয় ওষুধের জন্য রীতিমত হাহাকার চলছে। একাধিক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দ্রুত ওষুধের ব্যবস্থা না করা গেলে কেবল চিকিৎসার অভাবে দেশটিতে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটবে।
সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, শ্রীলঙ্কার হাসপাতাল, ক্লিনিক ও অন্যান্য চিকিৎসাকেন্দ্র এবং ফার্মেসিগুলোর শেলফ থেকে প্রায় উধাও হয়ে গেছে জীবনরক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধ। ওষুধের অভাবে এমনকি হাসপাতালগুলোতে অপারেশন করা বন্ধ করে দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রটিকে দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় অধিকাংশ পণ্যই আমদানি করতে হয়। এসব পণ্যের মধ্যে ওষুধও রয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট চাহিদার ৮০ শতাংশেরও বেশি ওষুধ আমদানি করে শ্রীলঙ্কা।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান সংকট বিশ্বব্যাপী খাদ্য উত্পাদন ও সরবরাহে চরম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। পাশাপাশি সার ও জ্বালানি সরবরাহেও সংকট তৈরি করছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মহাপরিচালক কিউ দোংয়ু।
তিনি বলেন, সংকট থেকে উত্তরনে সারা বিশ্বের খাদ্য সরবরাহ নির্বিঘ্ন করা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাঁচটি সুপারিশ করেছেন তিনি। এর মধ্যে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও সার ব্যবসা খোলা রাখা, বাজারের স্বচ্ছতা এবং সংলাপকে শক্তিশালী করা, অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষ সহ দুর্বল গোষ্ঠীকে সমর্থন করা, অ্যাডহক নীতি প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে চলা এবং নতুন এবং আরো বৈচিত্র্যময় খাদ্য সরবরাহকারী চালু করার কথা জানান এফএও মহাপরিচালক।
কিউ দোংয়ু বলেন, বিশ্বের পঞ্চাশটি দেশ গম সরবরাহের ৩০ শতাংশ বা তার বেশি রাশিয়া এবং ইউক্রেনের উপর নির্ভর করে। তাদের মধ্যে অনেকেই স্বল্পোন্নত দেশ বা নিম্ন আয়ের, উত্তর আফ্রিকা, এশিয়া এবং নিকট প্রাচ্যের খাদ্য-ঘাটতি দেশ। অনেক ইউরোপিয় এবং মধ্য এশিয়ার দেশ তাদের সার সরবরাহের ৫০ শতাংশের বেশি রাশিয়ার উপর নির্ভর করে। এই দেশ দুটির মধ্যে চলমান সংকট পরের বছর পর্যন্ত ঘাটতি প্রসারিত হতে পারে। দেশ দুটির ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে সরবরাহ শৃঙ্খল এবং লজিস্টিক বাধা তৈরি হচ্ছে বলেও জানান এফএও মহাপরিচালক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১০৩
আপনার মতামত জানানঃ