গোটা বিশ্ব এখন রুদ্ধশ্বাসে নজর রাখছে রাশিয়া-ইউক্রেন রণাঙ্গনে। কেন বাজলো এই যুদ্ধের দামামা, এই যুদ্ধে কে জিতবে কে হারবে, এই যুদ্ধের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী হবে—তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। আর ক্রমেই এই যুদ্ধের পেছনে ন্যাটোর ভূমিকা নিয়ে অসন্তুষ্টি বাড়ছে গোটা বিশ্ব জুড়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জার্মানিতে ১১৯টি সামরিক ঘাঁটি, যুক্তরাজ্যে আছে ২৫টি, ইতালিতে আছে ৪৪টি, বেলজিয়ামে আছে ১১টি। অন্য দেশেও রয়েছে। এখানে প্রশ্ন আমেরিকার এতো ঘাঁটি ইউরোপে কেন? মূলত আমেরিকা এমন একটি যুদ্ধ চাইছিল, যেন ন্যাটোর অবস্থান আরও পোক্ত করা যায় এবং সেনা ঘাঁটি রাখার যৌক্তিকতা মেলে ধরা যায়।
প্রসঙ্গত, যুদ্ধ বন্ধে ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদানের পরিকল্পনা স্থায়ীভাবে বাতিল করতে হবে বলে দাবি করে রাশিয়া। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে আলোচনাও করে মস্কো। তবে রাশিয়ার প্রস্তাবগুলোকে ওয়াশিংটন বাধা হিসেবে দেখছে। যার ফলে যুদ্ধ হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী। ভুগছে গোটা ইউরোপ। বাড়ছে মূল্যস্ফীতি।
আর তাই ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলদের রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার বিক্ষোভকারী। ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠিত বিক্ষোভটিতে জীবিকানির্বাহে ব্যয়বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি ইউক্রেনীয় সংঘাতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোজোটের আগুনে ঘি ঢালার মতো অংশ নেওয়ার বিরুদ্ধেও বিক্ষোভ করছেন আন্দোলনকারীদের অনেকে। বিক্ষোভে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে পুরো শহর।
ট্রেড ইউনিয়নগুলো বলছে আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা ৮০ হাজার। তবে পুলিশের হিসাবে এই সংখ্যা ৭০ হাজারের কাছাকাছি। শহর অচল করে ফেলার পাশাপাশি আন্দোলনের মুখে ব্রাসেলসের বিমানবন্ধরের ফ্লাইটগুলোও গণহারে বাতিল করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। নিরাপত্তা কর্মীদের প্রতিনিধিত্বকারী ইউনিয়নগুলোও আন্দোলনে অংশ নেয় বলে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শহরের আশেপাশের সড়কগুলোতেও চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
দিনে দিনে বড় হচ্ছে ন্যাটো। সবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ইউরোপ আগ্রাসন ঠেকাতে ১৯৪৯ সালে মাত্র ১২টি দেশ নিয়ে গঠিত হয় নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অ্যালায়েন্স (ন্যাটো)।
গত মাসে নতুন করে ফিনল্যান্ডের যোগ দেওয়ার ঘোষণায় এর সদস্য সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৩২। সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ম্যাগডালেনা অ্যান্ডারসনও ন্যাটো সদস্যপদ পেতে ন্যাটোতে আবেদন করবেন বলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন ওই সময়ে।
ইউরোপকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স এই সামরিক জোট গঠনে নেতৃত্ব দেয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ধীরে ধীরে এর সদস্য দেশ বাড়তে থাকে। সর্বশেষ ২০২০ সালে উত্তর মেসিডোনিয়া ন্যাটোতে যোগ দিলে এর সদস্য ৩০ এ পৌঁছায়। সম্প্রতি রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন এর সদস্য হওয়ার খুব নিকটে রয়েছে।
ন্যাটোর প্রতিষ্ঠাকালীন দেশগুলো ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্স, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে এবং পর্তুগাল। ফিনল্যান্ড এর ৩১তম এবং সুইডেন ৩২তম দেশ হিসেবে ন্যাটেতে যোগ দিতে যাচ্ছে। মূলত ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের পর থেকে দেশ দুটি ন্যাটোর ব্যাপারে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গত, জুন মাসে বেলজিয়ামে মুদ্রাস্ফীতি ৯ শতাংশ ছুঁয়েছে, যা চার দশকের সর্বোচ্চ। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় বিক্ষোভকারীরা বেতন বৃদ্ধি ও কর কমানোর দাবিও জানায়।
রাশিয়ার ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা ও ইউক্রেনে ন্যাটোর অস্ত্র সরবরাহের কারণে সংঘাতের প্রভাব অর্থনীতিকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে তুলে ধরেন আন্দোলনকারীদের অনেকে।
আন্দোলনকারীরা বলেন, ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দের উচিত “অস্ত্রের পিছে ব্যয় না বাড়িয়ে বেতন বাড়ানো”। একইসঙ্গে “ন্যাটো বন্ধ করো” স্লোগানেও মুখরিত হয়ে উঠে বিক্ষোভ সমাবেশ।
ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের বিরুদ্ধে ইউরোপজুড়ে একইধরনের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। শনিবার লন্ডনের রাস্তায় ট্রেড ইউনিয়নের হাজার হাজার সদস্য মিছিল নিয়ে বের হয়। সেখানেও বিক্ষোভকারীদের অনেকে ন্যাটো ও তার সদস্যদের কার্যক্রমকে বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী করে।
ইইউ ও ন্যাটো দুটো জোটের সদরদপ্তরই ব্রাসেলসে। মাত্র তিন মাস আগে, ব্রাসেলসে কিছু বিক্ষোভকারী ইউক্রেনের পতাকা নাড়িয়ে ইইউকে ‘পুতিনের তেল’ কেনা থেকে সরে আসার দাবি জানায়। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ভবনগুলোর সামনেও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানিয়ে আন্দোলন হয়।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন ইউরোপীয় দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। গত সপ্তাহে তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞার কারণে এক বছরে ইইউ সরাসরি ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি হারাতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৩৫
আপনার মতামত জানানঃ