দালালের খপ্পরে পড়ে অবৈধভাবে বিভিন্ন দেশে পাচার বাংলাদেশিদের সহযোগিতা করায় তাদের বিরুদ্ধে উল্টো মানব পাচারের মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন এনজিওকর্মীরা।
তাদের ফেরত আনতে সহায়তা করায় দেশে উল্টো মামলা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের শিকার হচ্ছেন এনজিওকর্মীরা। দালালের মাধ্যমে বিদেশে গিয়ে কাজের বদলে নির্যাতনের শিকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করা এই মানুষদের পাশে দাঁড়ানোও বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মানব পাচারকারীরা এতটাই প্রভাবশালী।
গতকাল সোমবার অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কার্যালয়ে বিভিন্ন এনজিও এবং সিআইডি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় একাধিক এনজিও কর্মকর্তা এমন অভিযোগ করেন।
কর্মশালায় কীভাবে পাচার রোধ করা যায়, মানুষ যাতে পাচারের শিকার না হয়, পাচার হওয়া ব্যক্তিদের ফেরত আনতে কাজ করা বিভিন্ন এনজিও এ ক্ষেত্রে কী ভূমিকা পালন করতে পারে, তারা সিআইডিকে কীভাবে সহায়তা করতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে সিআইডির করণীয় কী—এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কর্মশালার শুরুতে মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বিভিন্ন এনজিওর কর্মকর্তারা তাদের অভিব্যক্তি তুলে ধরেন।
পাচার হওয়া ব্যক্তিদের দেশে ফেরত আনতে গিয়ে হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলে ধরে একটি উদাহরণ দিয়ে তারা বলেন, দিনাজপুরের একটি ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য ভুক্তভোগীদের ফেরাতে সহায়তা করতে গিয়ে ফেঁসে যান মামলার জালে।
তাদের অভিযোগ, ভুক্তভোগীরা তাদের ফেরত আনতে এনজিও কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন। কর্মকর্তারা বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অফিসকে অবহিত করেন। কিন্তু সরকারি ওই সংস্থা ও সংস্থার কর্মকর্তারা ভুক্তভোগীকে ফেরত আনা তো দূরের কথা, কোনো গুরুত্বই দিচ্ছে না। আবার কয়েকটি এনজিও উদ্যোগ নিয়ে পাচারের শিকার ভুক্তভোগীদের ফেরত আনায় উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে। পাচারের শিকার অনেক ভুক্তভোগী মানবপাচার চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করলেও পুলিশ আদালতে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণাদি জোগাড় করে দিতে পারছে না, দুর্বল অভিযোগপত্র দিচ্ছে। ফলে আদম ব্যবসায়ীরা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে।
পাচারের শিকার ব্যক্তিদের বিভিন্ন সময় ফেরত আনতে গিয়ে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা পোহাতে হয়েছে বিভিন্ন এনজিও সংশ্লিষ্টদের।
পাচারের শিকার অনেক ভুক্তভোগী মানবপাচার চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করলেও পুলিশ আদালতে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণাদি জোগাড় করে দিতে পারছে না, দুর্বল অভিযোগপত্র দিচ্ছে। ফলে আদম ব্যবসায়ীরা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে।
‘সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজ’–এর চেয়ারম্যান ইশরাত শামীম বলেন, ‘ভুক্তভোগী নারীকে উদ্ধারের পর অনেক সময় ঘটনার জন্য তার ওপরই দোষ চাপিয়ে গালাগালি করা হয়। পুলিশ সদস্যদের বুঝতে হবে ওই নারী ইচ্ছা করে পাচারের শিকার হননি। তাই তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে। আমি পাচারের শিকার নারী, শিশুদের সঙ্গে পুলিশ সদস্যরা কী ধরনের আচরণ করবে, তার ওপর বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ দিয়েছি।’
মানব পাচারে অধিকাংশ মামলার শাস্তি হয় না উল্লেখ করে কর্মশালায় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা বলেন, মানব পাচার একটি আন্তদেশীয় অপরাধ। তাই বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড় করা যায় না। ফলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা আদালতে প্রয়োজনীয় নথি উপস্থাপন করতে না পারায় শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। আবার অনেক সময় দেখা যায়, দেশ কিংবা বিদেশ থেকে পাচারের শিকার ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করার পর পাচারকারী চক্রের সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা টাকার বিনিময়ে আপস করে ফেলেন। এসব কারণে মানব পাচারের মামলায় জড়িত অপরাধীদের শাস্তি হচ্ছে না।
মানব পাচার রোধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বক্তরা বলেন, মানব পাচার রোধে হটলাইন চালু করা, সীমান্তবর্তী এলাকায় নজরদারি বাড়ানো ও যেসব দেশে বেশি পাচারের ঘটনা ঘটে, ওই সব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো, তথ্য আদান–প্রদানের ওপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি যেসব এলাকা থেকে মানুষ বেশি বিদেশ যান, ওই সব এলাকায় জনসচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি নিয়ে মানুষকে সচেতন করার প্রতি জোর দেন বক্তারা।
রাইটস যশোর’-এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, ‘প্রলোভনে পড়ে যারা পাচারের শিকার হয়, তারা মূল পাচারকারীকে চিনে না। ক্যারিয়ার ওভারসিজ নামের একটি রিক্রুটিং এজেন্সি বিদেশে লোক পাঠানো নিয়ে অনেক অনিয়ম করে। অনৈতিক লেনদেন করে। বায়রা এদের শেল্টার দেয়। আমরা (এনজিও) কিছু বলতে গেলে বায়রা মিলিয়ে দেয়।’
পাচারের শিকার ভুক্তভোগীকে আনতে গিয়ে উল্টো মামলা খেতে হয়েছে জানিয়ে বিনয় কৃষ্ণ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। বর্তমানে দুবাইয়ে দুজন এবং কিরগিজস্তানে দুজন মোট চারজন ব্যক্তি পাচার হয়ে সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করছে। তারা ও তাদের স্বজনেরা আমাকে অনুরোধ করছে তাদের দেশে ফেরত আনতে। তাদের ফেরত আনতে দূতাবাস, পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও পুলিশের আইজি বরাবর আবেদন করেছি। কিন্তু কোনো সদুত্তর পাইনি। দেড় লাখ টাকা হলে দুবাই থেকে দুজনকে ফেরত আনা সম্ভব, তাও অবৈধভাবে। তাহলে দূতাবাসকে জানিয়ে কী লাভ হলো? মোবারক নামের এক দালালের মারফত এরা সে দেশে গিয়েছে। মোবারকের পাসপোর্ট আছে, তার বাড়ি দিনাজপুর। অথচ তাকে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ।’
কর্মশালার প্রধান অতিথি সিআইডির প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মাহবুবুর রহমান বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের পাসপোর্ট, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাওয়া যায় না। আবার কেউ বিদেশে মারা গেলে মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়া যায় না। এসব কারণে মামলা তদন্তে বেগ পেতে হয়। মানব পাচার রোধে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। কর্মশালায় বাংলাদেশে মানব পাচার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ