যুদ্ধ ইউক্রেনকে বিশ্বের রুটির বাস্কেট থেকে দরিদ্রতম দেশে পরিণত করেছে। বিশ্বব্যাপী ১২৫ মিলিয়ন মানুষকে খাওয়ানোর জন্য যে শস্য ক্রয় করা হয়, তার ৫০ শতাংশ ইউক্রেন থেকে আসে। এ পরিস্থিতিতে ইয়েমেনের মতো যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অঞ্চলে রেশন কমানো শুরু করতে হচ্ছে, যেখানে ইতিমধ্যেই খাদ্য, জ্বালানি এবং পরিবহনের ক্রমবর্ধমান খরচের কারণে খাদ্য বরাদ্দের পরিমাণ অর্ধেকে নামানো হয়েছে।
ইউক্রেন ও রাশিয়া যৌথভাবে বিশ্বের গমের সরবরাহের ৩০ শতাংশ, ২০ শতাংশ ভুট্টা এবং ৭৫-৯০ শতাংশ সূর্যমুখী বীজের তেল উৎপাদন করে। মিসর ও লেবানন তাদের শস্য সরবরাহের ৮০ শতাংশ ইউক্রেন থেকে আমদানি করে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সফল আবেদন এবং আন্তর্জাতিক সামরিক ও মানবিক সহায়তায় ভরপুর দেশটির অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পতন দুর্ভাগ্যবশত ঠেকাতে পারেনি। ইউক্রেনকে অনেকেই এই বলে যুদ্ধে উৎসাহ দিচ্ছেন যে, হেরে না যাওয়াটা জয়ী হওয়ার শামিল। তবে দেশটির সামগ্রিক পরিস্থিতি বলছে যে, এই তথাকথিত ‘হেরে না যাওয়া’র প্রবোধ ইউক্রেনের হার ঠেকাতে পারছে না।
এই যুদ্ধে ইউক্রেন তার অন্তত ১০ শতাংশ সেনা হারিয়েছে। যদিও দেশটিকে অন্তত ৩১টি পশ্চিমা সরকার অস্ত্র এবং অন্যান্য সামরিক সরবরাহ দিয়ে সর্বাত্মক সহযোহিতা করেছে, ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, কর্মকর্তাগণ এবং স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধারা নীরবে স্বীকার করেছেন যে, তাদের এত সাহায্য উপলব্ধ করার ক্ষমতা নেই। কারণ, বেশিরভাগ সরঞ্জাম এবং অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য নতুন প্রশিক্ষণ এবং পর্যাপ্ত সময় প্রয়োজন। একইভাবে, ১৬ হাজার বা তার বেশি বিদেশী স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধার অংশগ্রহনকে আপাত দৃষ্টিতে আশীর্বাদ মনে হলেও, বাস্তবে তাদের প্রায় কারোরই সামরিক অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ নেই। ফলে তাদের বেশিরভাগই খাবার জন্য অতিরিক্ত মুখের চেয়ে বেশিকিছু হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে।
অর্থনৈতিকভাবে ইউক্রেন টিকে আছে। কিন্তু রাশিয়ার উপর যে নিষেধাজ্ঞাগুলি জিডিপির ৭ শতাংশের এর কম সম্ভাব্য সংকোচন বলে বিবেচিত হতে পারে, তা ইউক্রেনকে ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ জিডিপি পতনের সম্মুখীন করেছে। ইউক্রেনের কমপক্ষে ১৭ শতাংশ ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষ্ণ সাগরে ইউক্রেনের মারিউপোল, ওডেসা, খেরসন এবং অন্যান্য বন্দরগুলিতে অবরোধ দেশটির অর্থনীতিতে প্রতিদিন ১ শ’ ৭০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি করছে। ইউক্রেনের সরবরাহ ব্যবস্থা এবং শক্তি খাতও এখন ধ্বংসের সম্মুখীন। গ্যাসের বাজারের মন্দা এবং বিনা তহবিলে দেশটি কীভাবে প্রস্তুতি নেবে, স্পষ্ট নয় যেখানে তাপমাত্রা ২০ ফারেনহাইটের নিচে নেমে যেতে পারে।
এর মধ্যে, ৬ লাখেরও বেশি নারী ও শিশু ইউক্রেন থেকে পালিয়েছে। যদি পুরুষদের যাওয়ার দেশত্যাগের অনুমতি দেয়া হয়, তাহলে এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হবে। ইউরোপের দরিদ্রতম এই দেশটি যুদ্ধের বহু আগেই মেধাহীনতার সম্মুখীন ছিল। বহু নাগরিক উন্নত জীবনের খোঁজে দেশ ছেড়ে গেছে। ইন্টারন্যাশনাল লেবার এজেন্সি অনুমান, ইউক্রেনে ৪.৮ মিলিয়ন লোক চাকরি হারিয়েছে, যুদ্ধ চলতে থাকলে যা ৭ মিলিয়নে উন্নীত হবে। এবং বহু মাস যুদ্ধের পর শিশুরা বিদেশে নতুন স্কুলে মনযোগ স্থাপন করবে, মায়েরা তাদের নতুন জগতে থিতু হবে এবং তারা তাদের স্বামী এবং পিতার সাথে যোগ দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করবে। কেউ কেউ অবশ্যই ইউক্রেনে ফিরে আসবে, কিন্তু অনেকেই দেশপ্রেমের আহ্বানের চেয়ে তাদের পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্য এবং শিশুদের সুযোগকে অগ্রাধিকার দেবে।
শুধু ইউক্রেন না, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের প্রভাবে বিশ্ব এখন খাদ্য সংকটের মুখোমুখি। আর এই সংকট যেন বড় আকার ধারণ করার আগেই সামলে নেওয়া যায়, সেজন্য শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত লোকেদের রেশন (খাদ্য) প্রায় অর্ধেকে কমিয়ে এনেছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফপি)। খবর ব্লুমবার্গের।
ডব্লিউএফপির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলি সোমবার (২০ জুন) এক বিবৃতিতে বলেন, “শরণার্থীরা, যারা আমাদের ওপর নির্ভরশীল, তাদের খাদ্য রেশন কমানোর মতো হৃদয়বিদারক সিদ্ধান্ত নিতে আমরা বাধ্য হচ্ছি।”
জলবায়ুর পরিবর্তনের ধাক্কায় ফলন কম হওয়ায় একদিকে যেমন দাম বেড়েছে, অন্যদিকে যুদ্ধের প্রভাবে ক্ষুধার্তদের প বরাদ্দের তহবিলও কমেছে অনেকাংশে। ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের পর থেকে বেড়েই চলেছে খাদ্যের দাম।
যুদ্ধের কারণে খাদ্যশস্য ও উদ্ভিজ্জ তেলের মূল রপ্তানিকারক ইউক্রেন থেকে রপ্তানি তীব্রভাবে কমে যাওয়ায় দাম পৌঁছেছে রেকর্ড উচ্চতায়। আর এরসঙ্গে সদ্য হালকা হওয়া মহামারির প্রভাব তো আছেই।
এদিকে ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, সংকট মোকাবেলায় ইউক্রেন থেকে যেন গুরুত্বপূর্ণ কৃষি পণ্যের রপ্তানি পুনরায় শুরু করা যায়, সেই প্রচেষ্টাও চলছে ধীর গতিতে।
জাতিসংঘের সংস্থাটি বলছে, খাদ্য রেশন কমানোর এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইথিওপিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ সুদান এবং উগান্ডায় বসবাসকারী শরণার্থীরা।
ডব্লিউএফপি’র কার্যক্রম জুড়ে ইতিমধ্যেই উদ্বাস্তুদের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে রেশন কমানো হয়েছে। জাতিসংঘের হিম্যানিটারিয়ান অফিস (ওসিএইচএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের বিস্তৃত শুষ্ক মরুভূমি জুড়ে প্রায় ১৮ মিলিয়ন মানুষ আগামী তিন মাস মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হবে।
ওসিএইচএ’র মুখপাত্র জেনস লারকে জানান, এ অঞ্চল ৩.৮ বিলিয়ন ডলারের আবেদন করলেও তা থেকে ১২ শতাংশ কম অর্থায়ন করা হয়েছে।
গেল মে মাসে গণমাধ্যমে তিনি বলেছিলেন, “বার্কিনা ফাসো, চাদ প্রজাতন্ত্র, মালি এবং নাইজারের পরিস্থিতি ইতোমধ্যেই উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ অঞ্চলের মানুষ আগামী জুন থেকে আগস্ট- এ সময়ে মধ্যে চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হবেন।”
লারকের মতে, ২০১৪ সালের চেয়েও এবার ভয়াবহ একটি খাদ্য সংকট দেখতে যাচ্ছে বিশ্ব।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার মতে, গেল বছর ৬৭ শতাংশ উদ্বাস্তু এবং আশ্রয়প্রার্থীরা এমন দেশ থেকে এসেছে, যে দেশগুলো খাদ্য সংকটে ভুগছে। কেবল ইউক্রেন থেকেই ৬ মিলিয়ন মানুষ পালিয়েছে চলতি বছরের ৬ মাসে। ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট যে আরও লাখ লাখ শরণার্থীর জন্ম দিতে চলেছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বলছে, “খাদ্যের এই সংকট ধ্বংসাত্মক সংঘাত এবং জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতার সঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরি হয়েছে, যা শরণার্থীদের ওপর হেনেছে সবচেয়ে বড় আঘাত।”
খাদ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চাদ প্রজাতন্ত্রের বাস্তুচ্যুত এবং উদ্বাস্তু লোকেদের রেশনের পরিমাণ ইতোমধ্যেই অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। সামনের জুলাই থেকে যদি পর্যাপ্ত তহবিল না পাওয়া যায়, তাহলে এই পরিমাণ আরও কমাতে বাধ্য হবে সংস্থাটি।
এছাড়া, বার্কিনা ফাসোতে কমানোর পাশাপাশি মৌরিতানিয়ার এমবেরা ক্যাম্পেও খাদ্য রেশনের পরিমাণ ৫০ শতাংশ কমানো হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫৫
আপনার মতামত জানানঃ