স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে সিলেট বিভাগে ২২ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়।
পরিচালক হিমাংশু লাল রায় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত বন্যায় সিলেট বিভাগে ২০ জনের মৃত্যুর তথ্য আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে সিলেটে ১২ জন, মৌলভীবাজারে তিনজন ও সুনামগঞ্জে পাঁচজন।’
মঙ্গলবার সকালে সিলেটের জৈন্তাপুরে মা-ছেলের মরদেহ ভেসে উঠেছে। তাৎক্ষণিক এ দুই মরদেহের তথ্য তার কাছে নেই। তবে এ তথ্য যোগ হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। সে অনুযায়ী, বন্যায় সিলেট বিভাগে এখন পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে।
তবে রয়টার্সের বরাত দিয়ে আবহাওয়া বিষয়ক ওয়েবসাইট অ্যাকুওয়েদার জানিয়েছে, গত সপ্তাহের শেষের দিকে মৌসুমি বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার পর থেকে অন্তত ৩২ জন নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট প্রশাসনিক বিভাগে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা এর জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ।
এদিকে পুলিশ কর্মকর্তারা দ্য গার্ডিয়ানকে জানান, বজ্রপাতের কারণে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সী তিনজন শিশুসহ প্রায় ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এর আগে সোমবার পর্যন্ত সিলেটের জেলা প্রশাসক একজনের, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তিনজনের ও ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একজনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে স্থানীয় সূত্রে আরও কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও সত্যতা নিশ্চিত করেনি প্রশাসন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা কিংবা দুর্যোগে সরকার বরাবরই রাজনৈতিকভাবে তৎপর হয়ে ওঠে। গত আড়াই বছর ধরে সরকার করোনায় মৃত্যু নিয়ে বরাবরই প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে বহুগুণ কম প্রকাশ করে আসছে। এনিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোতে প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ করে সরকারের বিরোধী মনোভাবের নিন্দা জানিয়েছে। এবারও স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে রাজনীতি করছে সরকার। প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে অনেক কম বলে যেন সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে চাচ্ছে। আদতে এর হিতে বিপরীতটাই ঘটছে।
সিলেট ও সুনামগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ভয়াবহ বন্যা। দুই জেলার প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে গেছে পানিতে। সোমবার পর্যন্ত পানিবন্দি ছিলেন অন্তত ৪০ লাখ মানুষ। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক।
বাংলাদেশের সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পাহাড়ি ঢল আর অতি ভারী বৃষ্টিতে নদনদী ও হাওরের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যার আরও বিস্তৃতি ঘটেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন দুই জেলার প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা।
পানিবন্দি মানুষের মধ্যে হাহাকার ও আর্তনাদ চলছে। আশ্রয়ের খোঁজে পানি-স্রোত ভেঙে ছুটছে মানুষ। সবচেয়ে বিপদে আছেন শিশু ও বয়স্করা। আটকে পড়াদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হচ্ছে। যেখানেই শুকনো ও উঁচু জায়গা পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই আশ্রয় নিচ্ছে মানুষ।
বাংলাদেশ সরকারের তরফে জানা গিয়েছে, সেদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট এবং সুনামগঞ্জ বন্যার জেরে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বাকি দেশের থেকে। সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, দেশের দশ জেলার ৬৪ উপজেলা বন্যার কবলে পড়েছে। সেদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের কথায় ১২২ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে সিলেট ও সুনামগঞ্জে। ভারতের অসম-মেঘালয়ের প্রবল বৃষ্টির জেরেই পড়শি দেশের এই দুর্ভোগ বলে দাবি করেন মন্ত্রী।
বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের মেঘালয় ও আসামে বৃষ্টি হলে বাংলাদেশে উজান থেকে পানি আসা বন্ধ হবে না৷ সিলেট বিভাগের বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির আশা নেই৷ দেশের উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি আগামী দুই দিনের মধ্যে আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে৷
পানিবন্দি মানুষের মধ্যে হাহাকার ও আর্তনাদ চলছে। আশ্রয়ের খোঁজে পানি-স্রোত ভেঙে ছুটছে মানুষ। সবচেয়ে বিপদে আছেন শিশু ও বয়স্করা। আটকে পড়াদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হচ্ছে। যেখানেই শুকনো ও উঁচু জায়গা পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই আশ্রয় নিচ্ছে মানুষ।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ বলছে, সিলেট বিভাগের বন্যা এর আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে৷ উজান থেকে আসা ঢলে এই বিভাগের বেশির ভাগ এলাকা এখন পানির নিচে৷ সুনামগঞ্জে বিদ্যুৎ নেই, সুপেয় পানি নেই, মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নেই৷ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে৷
গত দুই মাসের মধ্যে তিন দফা বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট-সুনামগঞ্জ৷ তবে এবারের বন্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে৷ সিলেটে কেন এত ঘন ঘন বন্যা? গবেষকরা বলছেন, অতিবৃষ্টির কারণেই এই বন্যা। তবে এর বাইরেও বেশ কিছু কারণ আছে৷
হাওরে অবকাঠামো নির্মাণ, নদীর তলদেশ পলিমাটিতে ভরে যাওয়া, অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলন, পুকুর-খাল ময়লা আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাওয়াকেও দায়ী করছেন তারা৷
এবারের বন্যা এত ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রেল স্টেশন, এয়ারপোর্ট সবই বন্ধ করে দিতে হয়েছে৷ পুরো সিলেট শহর এখন পানির নিচে৷ এখন পর্যন্ত অন্তত ৪০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন৷ বিদ্যুৎহীন সিলেট-সুনামগঞ্জের মানুষ পুরো নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন৷ সুনামগঞ্জ পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে৷ পরিস্থিতি ভয়াবহতা এতটাই বেশি যে, সামাল দিতে সিভিল প্রশাসনের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে নামাতে হয়েছে৷
গবেষকরা বলেন, ‘সিলেট বিভাগে বন্যা এতটা তীব্রতা পাওয়ার কারণ, পানি নামতে বাধা পাচ্ছে৷ হাওরে নানা অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে৷ এটা পানি প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করছে৷ কারণ এই অঞ্চলের পানি হাওর হয়ে নদী দিয়ে নেমে যায়। শুধু এই অবকাঠামো নয়, পাশাপাশি নদী নাব্যতা হারিয়েছে। এতে পানি দ্রুত সরতে পারছে না’৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বন্যা পরিস্থিতি জীবন ও জীবিকার অপূরণীয় ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। এবারের বন্যায় বাংলাদেশসহ ভারতের আসাম, মেঘালয়, চেরাপুঞ্জির অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের বড় দায় রয়েছে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক হাওর-বাঁওড়, নদ-নদী এলাকাসহ বিভিন্ন জলাশয়-জলাভূমির পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস ও স্বাভাবিক পানিপ্রবাহের গতিপ্রকৃতির পরিবর্তনের দায়কেও অস্বীকার করা যাবে না।
তারা বলেন, বিগত দশকগুলোতে হাওর এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে বন্যাসহ বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবিলার প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার উপাদানগুলো নষ্ট করে বিপদ ডেকে আনা হয়েছে। এ বিষয়গুলো উপেক্ষা করলে সামনের দিনগুলোতে আরও বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এ বছর সারাদেশেই দীর্ঘস্থায়ী বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী বছরগুলোতেও নিয়মিতভাবে এ ধরনের বন্যা দেখা দিতে পারে। তাই আগামী দিনে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে আমাদের বাঁচতে হলে হাওর-বাঁওড়, নদী-খাল, জলাশয়-জলাভূমি প্রভৃতি প্রাকৃতিক জল ধারণ এলাকা সংরক্ষণের বিকল্প নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৬
আপনার মতামত জানানঃ