গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ভয়াবহ বন্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি। রাস্তায় ধস নেমে বন্ধ অরুণাচলের একাধিক পাহাড়ি রাস্তা। ত্রিপুরার একাধিক অঞ্চলে রাস্তায় নৌকা চলছে। বন্যা এবং ধসে বিধ্বস্ত মেঘালয়। বন্যা পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের তিনটি জেলায়। দার্জিলিং-কালিম্পংয়ের রাস্তায় ধস। তবে এখনো পর্যন্ত বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে আসামে।
ভারতের আসামে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বন্যায় তিন শিশুসহ আরও ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১।
অবিরাম বৃষ্টিতে সৃষ্ট বিধ্বংসী বন্যা আসামকে ধ্বংস করে চলেছে এবং প্রায় ৫ হাজার ১৩৭টি গ্রাম বন্যার পানির নিচে চলে গেছে।
বন্যার্তরা বলেন, পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ায় তারা এখন সবকিছু সৃষ্টিকর্তার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।
ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদন জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় তিন শিশু-সহ নয়জনের মৃত্যু হয়েছে। সব মিলিয়ে এবছর আসামের বন্যায় মোট মৃতের সংখ্যা ৭১ এ পৌঁছেছে। তবে চলতি বন্যায় এখনো পর্যন্ত মৃত্যু ৩৭ জনের। বহু মানুষ নিখোঁজ। ঘরছাড়া লাখ লাখ মানুষ।
আসামের কাছার, হায়লাকান্দি, বরপেটা, কামরুপ, করিমগঞ্জ-সহ মোট ৩৩টি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। রোববার কাছারে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। ধসের কারণেই তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে। আসাম সরকারের প্রাথমিক রিপোর্ট বলছে, এখনো পর্যন্ত বন্যা এবং ধসে প্রায় ৪২ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বহু মানুষ বাড়িছাড়া। তাদের ত্রাণ শিবিরে রাখা হয়েছে। রোববার চারজন নিখোঁজ হয়েছেন বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।
আসামের পাঁচ হাজার ১৩৭টি গ্রাম আপাতত জলের তলায় বলে প্রশাসন জানিয়েছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বরপেটা জেলার। সেখানে ১২ লাখ ৭৬ হাজার মানুষ বন্যার কারণে ঘরছাড়া। দারাং এবং নওগাঁওয়ের অবস্থাও ভয়াবহ। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বেশকিছু গ্রাম কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বলে স্থানীয় প্রশাসন সংবাদসংস্থাকে জানিয়েছে। চর এলাকাতেও পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। কাজিরাঙা অভয়ারণ্যের ভিতরে বন্যার জল ঢুকেছে বলে জানা গেছে। প্লাবিত জঙ্গলসংলগ্ন একাধিক গ্রাম।
যাদের গবাদি পশু আছে তারা পড়েছেন আরও বিপাকে। পানির কারণে নিরাপদ স্থানে নেওয়াটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কিছু কিছু স্থানে দেখা দিয়েছে ভূমিধস।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, যাদের গবাদি পশু আছে তারা পড়েছেন আরও বিপাকে। পানির কারণে নিরাপদ স্থানে নেওয়াটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কিছু কিছু স্থানে দেখা দিয়েছে ভূমিধস। এতে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
জানা যায়, আসামের এই বন্যায় এক লাখ ৭৩ হাজারের বেশি ফসলি জমি প্লাবিত। এমন পরিস্থিতিতে সামনে খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার শঙ্কা রয়েছে রাজ্যটিতে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কপিলি নদীর পানি বেড়ে হোজাই জেলায় দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে। প্রতিবেশি দেশ ভুটানের বেশ কয়েকটি বাঁধ থেকে অতিরিক্ত পানি ছাড়ায় আসামের নিম্ন জেলাগুলোয় মারাত্মক প্রভাব পড়েছে।
এদিকে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে একের পর এক ধস নামছে। ধস নেমে সমতল থেকে পাহাড়ে যাওয়ার মূল সড়ক অবরুদ্ধ হয়ে গেছিল। উত্তরবঙ্গের তিনটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারে নদী বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। আলিপুরদুয়ারে কোনো কোনো অঞ্চলে জল ঢুকতে শুরু করেছে বলে স্থানীয় মানুষ জানিয়েছেন। বক্সা এবং জয়ন্তীতে বন্যা শুরু হওয়ায় কিছু পর্যটক আটকে পড়েছেন।
জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহারেও বিপদসংকেত জারি হয়েছে। গজলডোবায় তিস্তা ব্যারেজের জল ছাড়া হচ্ছে। জল ছাড়া না হলে ব্যারেজ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা আছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহারে বন্যার আশঙ্কা আরো বেড়েছে। তারই মধ্যে আবহওয়া দপ্তর গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতে বৃষ্টির কমলা সংকেত জারি করেছে। যার ফলে পরিস্থিতি আরো বিপজ্জনক হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
আসামসহ উত্তর–পূর্ব ভারতের নদীতে বৃষ্টিপাতের ফলে পানি বেড়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে বন্যা নিয়ে গবেষণা করেন অরবিন্দ গোস্বামী। তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে, এই নদীগুলোতে পলি জমার সমস্যা রয়েছে এবং বরাবরই ছিল। পলি তোলার কাজ যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ এবং পাহাড়ি উপত্যকা অঞ্চলে কঠিনও। ফলে একদিকে ধারাবাহিক বৃষ্টি এবং অন্যদিকে পলি জমে থাকার সমস্যায় বিপদ বাড়ছে।
আসামে ব্রহ্মপুত্রের পানি অনেক জায়গাতেই বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। ব্রহ্মপুত্রর উৎস তিব্বতে। সেখানে ইয়ারলাং সংপো নামে পরিচিত ব্রহ্মপুত্রের প্রায় ৬০ শতাংশ রয়েছে, ৩০ শতাংশ ভারতে এবং বাংলাদেশে ১০ শতাংশ।
ব্রহ্মপুত্রের একাধিক গুরুতর সমস্যা বর্ষাকালে এলে বোঝা যায়। হিমালয়ের হিমবাহ গলে যায় তিব্বতে এবং অরুণাচল প্রদেশে, যেখানে ব্রহ্মপুত্রের নাম শিয়াং। এর ফলে ব্রহ্মপুত্রে পানির মাত্রা বাড়ে। এ ছাড়া ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় একাধিক নদী রাতারাতি স্ফীত হয় বর্ষার পানিতে। এ ছাড়া পলির সমস্যা তো রয়েছেই।
অরিন্দন গোস্বামী বলেন, নদী যখন পাহাড়ে থাকে, তখন সেখানে পলি জমার সমস্যা অনেক কম থাকে। এর কারণ, সেখানে নদীর গতি বেশি এবং তা পলিকে বয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু যত নদী সমতলের দিকে আসে, ততই পলি জমতে থাকে। তা নিয়মিত অববাহিকা থেকে তোলার দরকার আছে, যা করা হয় না। তিব্বত ও অরুণাচল প্রদেশে নদীতে পলি জমার খুব একটা সুযোগ না থাকলেও আসাম ও বাংলাদেশে রয়েছে। যে কারণে এই অঞ্চলে নিয়মিত বন্যা হয়।
এ ছাড়া ওই অঞ্চলে একাধিক উপনদী রয়েছে। তার পানি এসে ব্রহ্মপুত্র হয়ে তিস্তা হয়ে সেখান থেকে বাংলাদেশে ঢোকে। সব সমস্যাই বর্ষাকালে বাড়ে এবং বন্যা হয়।
অরুণাচল প্রদেশ ও আসামে একাধিক বাঁধ দিয়ে এই সমস্যার মোকাবিলা করার চেষ্টা হলেও তা কার্যকর হয়নি। বরং বড় বাঁধ ও ছোট ছোট নদীতে বাঁধ বানিয়ে নদীকে বেঁধে ফেলার চেষ্টায় তার তীব্রতা আরও বেড়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
ভারত এখন অরুণাচল প্রদেশে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাঁধটি বানানোর কথা ভাবছে, যাতে পানির নিচের দিকে আসা কিছুটা রোধ করা যায়। কিন্তু তা কার্যকর করা যাবে কি না, তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। কারণ, সেখানকার মানুষ ৫০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে প্রস্তাবিত বাঁধ বানানোর বিরোধিতা করছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৮
আপনার মতামত জানানঃ