বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলায় ১০০ বিচারক একটি প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রতিবাদে ব্যানার হাতে মানবন্ধন, বক্তৃতা ও মিছিলে অংশ নেন বিচারকরা। কিন্তু দেশের আইন, উচ্চ আদালতের রায় ও নির্দেশনা অনুযায়ী বিচারকদের এ ধরনের কর্মসূচি পালনের সুযোগ রয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
১২ ডিসেম্বর ২০২০, গতকাল শনিবার সকালে নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইন সংলগ্ন সড়কে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম জেলা কমিটির ব্যানারে মানববন্ধন ও মিছিল কর্মসূচি পালিত হয়। ‘জাতির পিতার সম্মান, রাখবো আমরা অম্লান’ স্লোগান সম্বলিত ব্যানার ধারণ করেন বিচারকরা। মানবন্ধন শেষে চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাইল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘চট্টগ্রামের একশ বিচারক আজকের এই প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিয়েছে। তারা দেশ এবং জাতিকে জানাতে চাচ্ছে, বিচারকেরা শুধু বিচার করে না, তারা প্রতিবাদ মিছিলেও অংশ নিতে জানে। জাতির জনকের প্রশ্নে কোনো আপোস নেই।’
প্রশ্ন উঠেছে, চট্টগ্রামের মাননীয় বিচারকরা রাস্তায় নেমে বঙ্গবন্ধুর সম্মান অম্লান রাখার স্লোগান দিচ্ছেন। সমাবেশে দাঁড়িয়ে তারা দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। কিন্তু এসব সংকট সমাধানের জন্য দেশে আইনের শাসন আছে। বিচারকদের হাতে রয়েছে এসব আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতা। বিচারকরা কেন আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন না? কেন তারা আদালতে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ডেকে তাদের বক্তব্য বা অবস্থান বুঝিয়ে দিচ্ছেন না। কোনোপ্রতিবন্ধকতা থাকলে বিচারবিভাগের মাধ্যমে সহজেই এর বিধান করা যেত। অথচ তা না করে বিচারকরা রাস্তায় নেমেছেন।
রাস্তায় নেমে মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা কি বিচারকদের জন্য প্রণীত বিধিমালার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ? এমন যৌক্তিক প্রশ্নের সাপেক্ষে স্টেটওয়াচ অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে উচ্চ আদালতের বিচারকদের আচরণবিধি চূড়ান্ত করে দিয়েছিল আপিল বিভাগ। নিম্ন আদালতের বিচারকদের জন্য আলাদা কোনো বিধি না থাকলেও উচ্চ আদালতের ওই আচরণবিধিই দিকনির্দেশনা স্বরূপ।
৩১ জুলাই ২০১৭ সোমবার প্রকাশিত ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারকদের আচরণবিধি বলে কিছু নেই, এমন একটা কথা বলা হলেও তা সত্য নয়। “বিচারকদের আচরণবিধি ছিল বলেই বিচারপতি সৈয়দ শাহিদুর রহমান সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে অপসারিত হয়েছেন।” পেশাগত অসদাচরণের কারণে হাই কোর্টের অতিরিক্ত বিচারক সৈয়দ শাহিদুর রহমানকে অপসারণের সিদ্ধান্ত বহাল রেখে আপিল বিভাগ গতবছর যে রায় দিয়েছিল, তার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিতে বিচারকদের জন্য ৪০ দফার একটি আচরণবিধি ঠিক করে দেওয়া হয়।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, “কোনো রকম বিভ্রান্তি বা সংশয় যাতে দেখা না যায়, সেজন্য আমরা সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে আচরণ বিধিটি সংস্কার করে দিলাম।” সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান পুনর্বহালের পাশাপাশি তা কার্যকর করতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য ৩৯ দফার আচরণবিধি চূড়ান্ত করে দিয়েছে আপিল বিভাগ।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য আপিল বিভাগ যে ৩৯ দফার আচরণবিধি চূড়ান্ত করে দিয়েছে তার ১৫ নম্বরে বলা হয়েছে, “দেশে বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনো বিচারক জড়িত হতে পারবেন না।” ২১ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে, “একজন বিচারক জনবিতর্কে অংশ নেবেন না। বিচারাধীন কোনো বিষয় বা রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে প্রকাশ্যে নিজের মত প্রকাশ বা আলোচনায় তিনি অংশ নেবেন না।” ২৭ নম্বর বিধি অনুযায়ী, “ন্যায়বিচারের স্বার্থে একজন বিচারককে ব্যক্তিগত চলাফেরা বা সামাজিক মেলামেশা সীমিত রাখার নীতি গ্রহণ করতে হবে।”
[zoomsounds_player artistname=” এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞ ” songname=”ড. শাহদিন মালিক বলেন-” type=”detect” dzsap_meta_source_attachment_id=”2947″ source=”https://statewatch.net/wp-content/uploads/2020/12/শাহাদীন-মালিক.mp3″ thumb=”https://statewatch.net/wp-content/uploads/2020/12/শাহদিন-মালিক.jpg” config=”default” autoplay=”off” loop=”off” open_in_ultibox=”off” enable_likes=”off” enable_views=”off” enable_rates=”off” play_in_footer_player=”default” enable_download_button=”off” download_custom_link_enable=”off”]
এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদিন মালিক বলেন, “যত বড় অপরাধীই হোক না কেনো, সংবিধান তাকে ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই ভাস্কর্য ইস্যুতে যদি বিচারকরা কোন পক্ষ অবলম্বন করেন তখন অপরাধীর মনে হতে পারে সে ন্যায়বিচার পাবেনা, এটা আইনের শাসনের জন্য শুভ নয়।” কোন বিতর্কিত ইস্যুতে বিচারকদের এমন প্রতিবাদের নজির আছে কিনা জানতে চাইলে এই আইন বিশেষজ্ঞ জানান, এভাবে বিচারকরা পথে নেমে এসেছেন তা মনে পড়ে না।
[zoomsounds_player artistname=”একই প্রসঙ্গে” songname=”ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন-” type=”detect” dzsap_meta_source_attachment_id=”2949″ source=”https://statewatch.net/wp-content/uploads/2020/12/সারা-হোসেন.mp3″ thumb=”https://statewatch.net/wp-content/uploads/2020/12/সারা-হোসেন.jpg” config=”default” autoplay=”off” loop=”off” open_in_ultibox=”off” enable_likes=”off” enable_views=”off” enable_rates=”off” play_in_footer_player=”default” enable_download_button=”off” download_custom_link_enable=”off”]
ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলন যৌক্তিক, তবে এর বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদ বিচারকদের কাজ নয় বলে মনে করেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন। তিনি বলেন, বিচারকদের প্রতিবাদ জানানোর নির্দিষ্ট ফোরাম রয়েছে এর বাইরে করার কথা নয়। দেশজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব ঘটনা ঘটছে সেসব বিষয়ে বিচারকদের সোচ্চার হওয়া উচিত।
চট্টগ্রামে বিচারকদের এমন প্রতিবাদ কর্মসূচির বিষয়ে সুপ্রীম কোর্ট এবং প্রধান বিচারপতির বক্তব্য আশা করেন, বিশিষ্ট এই আইনজীবী।
আইনবিদদের মতে, বিচারকরা প্রতিবাদ কর্মসূচিতে গেলে প্রতীয়মান হয় যে, আইনের দ্বারা এই সংকট সমাধানের সুযোগ নেই। কারণ আইনি সমাধান থাকলে তো বিচারকদের সেই মোতাবেক আদালতেই ব্যবস্থা নেয়ার কথা। তবে আইনের ফাঁক থাকলে বিচারকরা প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন, বিচারবিভাগের সহায়তায় বিষয়টি সরকারের কাছেও উত্থাপন করতে পারেন। কিন্তু তা না করে রাস্তায় নেমে মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধনে অংশ নেয়াতে এটাই প্রতীয়মান হলো যে, ওই বিচারকরা আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে নেতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।
আপনার মতামত জানানঃ