কক্সবাজারে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা মামলার চার্জশিট জমা দিয়েছে পুলিশ। সাড়ে ৮ মাস তদন্ত শেষে সোমবার দুপুরে ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তদন্ত গাজী সালাউদ্দিন।
রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যায় ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনী মুহিবুল্লাহকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্থানীয়ভাবে আল-ইয়াকিন নামে পরিচিত তিনি।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষের সচেতনতা সৃষ্টি, ক্যাম্পের ভেতর অনিয়ম ও অপরাধ নিয়ে সোচ্চার হওয়ায় আরসার ৩৬ জন সদস্য এই হত্যাকাণ্ড চালায়।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানিয়েছেন, এ হত্যাকাণ্ডে ৩৬ জনকে জড়িত হিসেবে শনাক্ত করা হলেও ৭ জনের ঠিকানা-অবস্থান শনাক্ত করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ কারণে বাকিদের নাম বাদ দিয়ে ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।
অভিযুক্তদের মধ্যে ১৫ জন বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। বাকি ১৪ জন এখনো পলাতক। তিনি বলেন, অভিযোগপত্রে ৩৮ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। যার মধ্যে ৩ জন সাক্ষী ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লম্বাশিয়া ডি ব্লকে আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের কার্যালয়ে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন মুহিবুল্লাহ। তিনি ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন।
৩০ সেপ্টেম্বর মুহিববুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্ত ভার পান উখিয়া থানার ওসি তদন্ত সালাহ উদ্দিন। তদন্ত শেষে সোমবার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়।
আদালত সূত্র জানিয়েছে, গ্রেপ্তার ১৫ জনের মধ্যে ৪ জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। একই সঙ্গে ৩ জন সাক্ষীও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
কে এই মুহিবুল্লাহ
রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ ১৯৯২ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আসেন। তখন থেকেই টেকনাফ অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে নানাভাবে রোহিঙ্গাদের সংগঠিত করতে থাকেন।
মুহিবুল্লাহ ২০০০ সালের শুরুতে ১৫ জন সদস্য নিয়ে গড়ে তোলেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানরাইটস’ নামের সংগঠন, যা এআরএসপিএইচ নামে বেশি পরিচিত। অন্যদেশের পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশি মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গেও গড়ে তোলেন গভীর যোগাযোগ। ধীরে ধীরে মুহিবুল্লাহ হয়ে ওঠেন প্রধান পাঁচ রোহিঙ্গা নেতার একজন।
বিদেশিদের কাছে আগে থেকে পরিচিত হলেও ২০১৭ সালে তিনি বনে যান রোহিঙ্গাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। সে সময় কয়েক লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিলে তাদের যোগাযোগে ভূমিকা রাখতে থাকেন নিয়মিত।
মুহিবুল্লাহ কয়েক দফায় সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন। তার উত্থানে সহায়ক হয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ২০১৮ সালে ইউএনএইচসিআরকে সংযুক্ত করার ঘটনা।
ইংরেজি ভাষা জানা ও রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের দক্ষতা মুহিবুল্লাহকে ধীরে ধীরে বিদেশিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিদেশি প্রতিনিধিরা যখনই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গেছেন, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই রোহিঙ্গা প্রতিনিধি হিসেবে মুহিবুল্লাহ যোগ হয়েছেন। তার সঙ্গীদেরকেও প্রতিনিধি করেন।
মূলত বিদেশি সংস্থা ও সংগঠনগুলো দেশে ফেরার বিষয়ে যখন রোহিঙ্গাদের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেছে তখনই মুহিবুল্লাহর সংগঠন এআরএসপিএইচ ভিন্ন কাজ করেছে। তারা ক্যাম্পে নানা প্রচারনা চালিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করেন এবং প্রত্যাবাসনে বাধার চেষ্টা চালিয়ে যান। কয়েক দফায় বিক্ষোভের আয়োজন করেন।
মুহিবুল্লাহ এক পর্যায়ে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিবকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংলাপের প্রস্তাব দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ১৭ দেশের যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২৭ প্রতিনিধি সাক্ষাৎ করেছিলেন সেখানেও যোগ দিয়েছিলেন মুহিবুল্লাহ।
কতটা বিপজ্জনক আরসা
মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর হামলা। ওই হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এখন তারা বাংলাদেশেও আধিপত্য বিস্তার করছে। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে মাদক বিক্রি, মানবপাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি ও মাদকের টাকায় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের কাজ করছে ‘আল-ইয়াকিন’। এই বাহিনী বাংলাদেশিদের অপহরণ করে নির্জন পাহাড়ে নিয়ে যায়। এরপর হাত-পা ও চোখ বেঁধে চলে নির্মম নির্যাতন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবিকৃত টাকা পেলে ছেড়ে দেওয়া হয়, না হলে পাহাড়ে গর্ত করে পুঁতে ফেলে। কক্সবাজারে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামেও এরা পরিচিত। কক্সবাজারবাসী এদের ‘জঙ্গি বাহিনী’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
জানা গিয়েছে, মিয়ানমারের এই সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) নিজেদের আরও মজবুত করতে এবার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে তাদের নিজস্ব মুদ্রা চালু করেছে। প্রাথমিকভাবে কয়েকটি ক্যাম্পে এ মুদ্রা চালু করলেও পর্যায়ক্রমে সব ক্যাম্পেই এ মুদ্রা চালু করতে চায় তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের গ্রুপে তারা এ মুদ্রার পক্ষে প্রচারণাও শুরু করেছে।
সূত্র মতে, বর্তমানে আল-ইয়াকিনের প্রায় দুই হাজার সদস্য রয়েছে কক্সবাজারে। দেড়শ’র মতো নারী সদস্যও রয়েছে তাদের। কক্সবাজার ও টেকনাফের প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তারা। তবে কুতুপালং ও বালুখালিতে তাদের সদস্য সংখ্যা বেশি।
কক্সবাজার পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে আল-ইয়াকিনের হাতে কমপক্ষে ২৫ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি নাগরিক খুন হয়েছেন। প্রায়ই স্থানীয়দের (বাংলাদেশি) অপহরণ করে তারা। নির্জন পাহাড়ে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের সংবাদও শোনা যায়। ভুক্তভোগী এমন বেশ কয়েকটি পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ পাহাড়ে অভিযান চালায়। তবে এখন পর্যন্ত এ চক্রের একজন সদস্যকেও গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আগে ইংরেজীতে ‘ফেইথ মুভমেন্ট’ নামে তাদের তৎপরতা চালাতো। স্থানীয়ভাবে এটি পরিচিত ছিল ‘হারাকাহ আল ইয়াকিন’ নামে। মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে একটি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী বলে ঘোষণা করে।
মিয়ানমারের সূত্র মতে, এই গ্রুপটির নেতৃত্বে রয়েছে রোহিঙ্গা জিহাদীরা, যারা বিদেশে প্রশিক্ষণ পেয়েছে। তবে সংগঠনটি কত বড়, এদের নেটওয়ার্ক কতটা বিস্তৃত, তার কোন পরিস্কার ধারণা তাদের কাছেও নেই।
মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের ধারণা, এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছে ‘আতাউল্লাহ’ নামে একজন রোহিঙ্গা। তার জন্ম করাচীতে, বেড়ে উঠেছে সৌদি আরবে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ তাদের এক রিপোর্টে বলছে, সংগঠনটি মূলত গড়ে উঠেছে সৌদি আরবে চলে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দ্বারা।
মক্কায় থাকে এমন বিশ জন নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা এই সংগঠনটি গড়ে তোলে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতে এদের যোগাযোগ রয়েছে। সংগঠনটির নেতা আতাউল্লাহ ‘আবু আমর জুনুনি’ নামেও পরিচিত। আতাউল্লাহর বাবা রাখাইন থেকে পাকিস্তানের করাচীতে চলে যান। সেখানেই আতাউল্লাহর জন্ম। তিনি বেড়ে উঠেছেন মক্কায়। সেখানে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন।
ইউটিউবে তার একটি ভিডিও থেকে ধারণা করা হয়, রাখাইনের রোহিঙ্গারা যে ভাষায় কথা বলে সেটি এবং আরবী, এই দুটি ভাষাই তিনি অনর্গল বলতে পারেন। ২০১২ সালে আতাউল্লাহ সৌদি আরব থেকে অদৃশ্য হয়ে যান। এরপর সম্প্রতি আরাকানে নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর তার নাম শোনা যায়।
আরাকানে যারা এই সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত, তাদের আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ আছে বলে মনে করা হয়। স্থানীয় রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই সংগঠনটির প্রতি সমর্থন এবং সহানুভূতি আছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮২২
আপনার মতামত জানানঃ