কয়েক সপ্তাহ আগে তাইওয়ানের বিষয়ে চীনকে সতর্ক করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এরপর বেইজিং এ যাবৎকালের সবচেয়ে কড়া ভাষায় তার প্রতিবাদ করে। চীন বলছে, তাইওয়ানের স্বাধীনতার ‘যেকোনো প্রচেষ্টা দৃঢ়তার সঙ্গে চুরমার করে দেবে’ দেশটি। দুই পক্ষের এই কথার লড়াই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে গড়াবে কি না, এটাই এখন বড় প্রশ্ন।
তাইওয়ান স্বাধীনতা ঘোষণা করলে চীন যুদ্ধ শুরু করতে দ্বিধা করবে না। তাইওয়ান নিয়ে ক্ষমতাধর দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বন্দ্বের মধ্যে সর্বশেষ এ হুঁশিয়ারি দিল বেইজিং। পাশাপাশি দ্বীপটির স্বাধীনতা অর্জনে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিচ্ছে বলে গত রোববার চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ওয়েই ফেঙ্গহি জোরালো অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘তাইওয়ান ইস্যুতে নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে’ এবং চীনের বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ’ করছে।
সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এশীয় নিরাপত্তা সম্মেলন শাংরি-লা ডায়ালগ-এ চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমাকে বিষয়টি স্পষ্ট করতে দিন—কেউ যদি তাইওয়ানকে চীন থেকে আলাদা করতে চায়, আমরা যুদ্ধ করতে দ্বিধা করব না। আমরা সবকিছুর বিনিময়ে লড়ব। আমরা একেবারে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাব। চীনের সামনে একমাত্র এই পথই খোলা।’
এর আগে চীনকে উদ্দেশ্য করে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, তাইওয়ানের কাছে যুদ্ধবিমান উড়িয়ে ‘বিপদ নিয়ে খেলছে’ চীন। আক্রান্ত হলে সামরিকভাবে দ্বীপটিকে রক্ষা করারও অঙ্গীকার করেন তিনি।
তাইওয়ান নিজেদের সার্বভৌম জাতি হিসেবে মনে করে। তবে দ্বীপটিকে নিজের অংশ বলেই দাবি করে আসছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের সবচেয়ে বড় মিত্র মনে করে তাইওয়ান। দ্বীপটির আত্মরক্ষায় সহযোগিতা প্রদান নিয়ে ওয়াশিংটনের একটি আইনও রয়েছে।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় এই কথার লড়াই শুরু হয়েছে। তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা অঞ্চলে যুদ্ধবিমান পাঠানো বাড়িয়েছে চীন। গত মাসে চলতি বছরের সবচেয়ে বড় যুদ্ধবিমান বহরটি পাঠিয়েছিল দেশটি। এদিকে তাইওয়ানের জলসীমায় নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
চীন তাইওয়ানে আগ্রাসন চালালে যুদ্ধ শুরু হবে এটাই বড় দুশ্চিন্তা। অতীতে বেইজিং বলেছে, প্রয়োজনে দেশটি শক্তি প্রয়োগ করে দ্বীপটি দখলে নেবে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখনই তেমন কিছু হচ্ছে না।
তাইওয়ানে আগ্রাসন চালিয়ে সফল হওয়ার মতো সামরিক সামর্থ্য চীনের আছে কি না, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নিজেদের আকাশ ও সমুদ্র প্রতিরক্ষা তাইওয়ান লক্ষণীয়ভাবে বাড়িয়ে চলেছে।
অবশ্য অনেকেই এ বিষয়ে একমত, তাইওয়ানে আগ্রাসন চালানোর মতো পদক্ষেপের মূল্য যে অনেক চড়া এবং ধ্বংসাত্মক হবে, বেইজিং তা স্বীকার করে নিয়েছে। আর তা কেবল চীনের জন্যই নয়, বরং গোটা বিশ্বের জন্যও।
ইনস্টিটিউট অব সাউথইস্ট এশিয়ান স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো উইলিয়াম চুং বলেন, অনেক কথার লড়াই হচ্ছে। তবে তাইওয়ানে আগ্রাসন চালাতে চাইলে চীনকে খুব খেয়াল করে ব্যবধানটা মাথায় রাখতে হবে, বিশেষ করে, বিষয়টা খুব বেশি ইউক্রেন সংকটের মতো হওয়ায়। চীনের অর্থনীতি রাশিয়ার চেয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে অনেক বেশি যুক্ত।
তাইওয়ানের সঙ্গে ‘শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলন’ চায় চীন। এ অবস্থানের ধারাবাহিকতার বিষয়টিই রোববার পুনর্ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। বলতে চেয়েছেন, উসকানিমূলক আচরণ করলেই কেবল ব্যবস্থা নেবে দেশটি।
এই কাজটি হতে পারে যদি তাইওয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তবে বিষয়টি কঠোরভাবে এড়িয়ে গেছেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন। যদিও তিনি জোর দিয়ে বলেন, তারা ইতিমধ্যেই একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র।
তাইওয়ানের অধিকাংশ নাগরিকই এই অবস্থান সমর্থন করে। এটা ‘স্থিতাবস্থা বজায় রাখা’ হিসেবে পরিচিত। যদিও ছোট একটি অংশ ক্রমাগত বলছে, তারা স্বাধীনতার দিকে এগোতে চায়।
একইভাবে, এশিয়ায় চড়া মূল্যের একটি সামরিক সংঘাত জড়িয়ে পড়তে যুক্তরাষ্ট্রও অনিচ্ছুক হবে। দেশটি বারবার ইঙ্গিত দিচ্ছে, তারা যুদ্ধ চায় না।
সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সংলাপে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনও অংশ নেন। তিনি বলেন, তাইওয়ানের স্বাধীনতা সমর্থন করে না যুক্তরাষ্ট্র, দেশটি ‘নতুন একটি স্নায়ুযুদ্ধ’ চায় না।
এস রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো কলিন কোহ বলেন, তাইওয়ান ইস্যুতে উভয় পক্ষই তাঁদের প্রতিশ্রুতির বিষয়ে অটল। এ বিষয়ে তাদের শক্ত অবস্থান দেখাতে হবে, যাতে মনে না হয় তারা সরে যাচ্ছে কিংবা পিছু হটছে।
কলিন কোহ বলেন, অবশ্য একই সময়ে পুরোপুরি একটি সংঘাতে পা বাড়ানোর বিষয়েও তারা খুবই সজাগ। তারা খুব ভালোভাবেই পরস্পরের কথার লড়াইয়ের ওপর নজর রাখছে। দুই পক্ষই ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করছে।
কলিন কোহ বলেন, বাস্তবতা হলো—শাংরি-লা ডায়ালগ সম্মেলনের সাইডলাইনে ওয়েই ও অস্টিন বৈঠক করেছেন, যা ইতিবাচক লক্ষণ। এর মানে হলো—দুই পক্ষই দেখাতে চায় ‘তারা এখনো বসতে ও কথা বলতে, ঐকমত্যে আসতে এবং দ্বিমত থাকা বিষয়গুলো নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে ইচ্ছুক।
কলিন কোহ আরও বলেন, এ ধরনের বৈঠকের ফলে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে কার্যকর আলোচনার পথ উন্মুক্ত হতে পারে। বাস্তবে পরস্পরের শক্তিমত্তা নিয়ে যে ভুল ধারণা সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে, এ ধরনের আলোচনা সেই আশঙ্কা কমাবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ‘সংলাপের সার্বিক পুনরুজ্জীবনের’ বিষয়টি অনুপস্থিত ছিল।
চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অদূর ভবিষ্যতেও তাদের কথার লড়াই অব্যাহত রাখবে বলেই অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের চীন বিশেষজ্ঞ ইয়ান চং বলেন, তাইওয়ানের সামরিক বাহিনীকে হতোদ্যম করে দিতে ও ধৈর্য পরীক্ষায় চীন তার জবরদস্তিমূলক কর্মকাণ্ড আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে আরও যুদ্ধবিমান পাঠানো কিংবা বিভ্রান্তমূলক প্রচারণার কাজটি করতে পারে।
দ্বীপটির নির্বাচনের আগে চীন বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা চালিয়েছে বলে অতীতে অভিযোগ করেছে তাইওয়ান। চলতি বছরের শেষ নাগাদ দ্বীপটিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ঘটনা সামনে থাকায় অন্তত এখনই তাদের অবস্থান পরিবর্তনের কোনো রাজনৈতিক ইচ্ছা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নেই। নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচন। চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসের কথা রয়েছে। এতে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং আরেক দফা তাঁর ক্ষমতা পোক্ত করতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইয়ান চং বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো দিক হলো কোনো পক্ষই উত্তেজনা বাড়াতে ইচ্ছুক নয়। কিন্তু উত্তেজনা না বাড়ানোর মানে এই নয় যে আমরা একটি ভালো অবস্থানের দিকে যাচ্ছি। তাই কিছু সময়ের জন্য আমরা এই অবস্থার মধ্যেই আটকে থাকছি।’
চীন আর তাইওয়ানের উত্তেজনার ইতিহাস
গত কয়েক বছরে কয়েক শতবার চীন তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে, তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে বেড়েছে চীনের সামরিক তৎপরতা। চীনের এই তৎপরতা মেকি হতে পারে, হতে পারে তাইওয়ানের সার্বভৌমত্বের জন্য সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ। তবে, তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে চীনের তৎপরতা বৈশ্বিক মনোযোগের কারণ হয়েছে।
চীন আর তাইওয়ানের এই উত্তেজনার একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে তাইওয়ানের ব্যাপারে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি। চীন তাইওয়ানকে দেখে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একটি প্রদেশ হিসেবে। আর বিশ্বাস করে, তাইওয়ান একসময় চীনের সাথে পুনরায় একত্রিত হবে, চীনের অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
তাইওয়ানে প্রথম বসতি স্থাপন করে অস্ট্রোনেশিয়ান নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা, যারা আধুনিক সময়ের সাউদার্ন চীন থেকে এসেছিলেন বলে মনে করা হয়। চীনের রেকর্ডে এই দ্বীপের প্রথম উপস্থিতি পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব ২৩৯ অব্দে, যখন তখনকার সম্রাট অনুসন্ধানী দলকে পাঠিয়েছিলেন এই অঞ্চলে অনুসন্ধান করতে। চীন যখন তাইওয়ানকে নিজের অংশ হিসেবে দাবি করে, তখন প্রাথমিকভাবে তাদের দাবির নৈতিক বৈধতা হিসেবে এই তথ্যটি উপস্থাপন করে। তাইওয়ান একটি ক্ষুদ্র সময় ডাচ কলোনি (১৬২৪-১৬৬১) হিসেবে ছিল, সেখান থেকে আবার তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ যায় কুইং সাম্রাজ্যের কাছে, তারা শাসন করে ১৬৮৩ সাল থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত।
সপ্তদশ শতাব্দী থেকে তাইওয়ানে বড় সংখ্যক অভিবাসী আসতে থাকে চীনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। জীবন আর জীবিকার সন্ধানে আসা এসব অভিবাসীদের অধিকাংশই এসেছিলেন ফুজিয়ান প্রদেশ থেকে, এসেছিল গাংডং থেকেও, যারা পরিচিত হাক্কা চাইনিজ নামে। ফুকিয়ান আর হাক্কা চাইনিজরা চীনের দুইটি বৃহৎ জাতিগোষ্ঠী।
১৮৯৫ সালের প্রথম সিনো-জাপানিজ যুদ্ধে চীনের কুইং সরকার পরাজিত হয় জাপানের কাছে, তাইওয়ান চলে যায় জাপানের সম্রাটের অধীনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাপান আত্মসমর্পন করে, তাইওয়ানের ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় চীনের কর্তৃত্ব। চীন শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের সম্মতিতে তাইওয়ান শাসন করতে থাকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই তিনপক্ষ ছিল বিজয়ীদের অংশে। কিন্তু, পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই চীনে একটি গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, চীনের তখনকার শাসক চিয়াং কাই-শেকের অনুগত বাহিনীর পরাজয় ঘটে মাও সেতুং এর কমিউনিস্ট বাহিনীর কাছে।
চিয়াং কাইশেক আর তার কুমিটাং সরকারের অনুসারীরা তখন তাইওয়ানে পালিয়ে যান। চিয়াং কাইশেকের অনুসারীরা ১৯৪৯ সালে তাইওয়ানে প্রবেশের স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাইওয়ানের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব গ্রহণ করে, পরবর্তীতে দীর্ঘসময় ধরে নিয়ন্ত্রণ করে চীনের রাজনীতিকে। চিয়াং কাইশেকের অনুসারীর সংখ্যা তখন ছিলো প্রায় দেড় মিলিয়ন, মোট জনসংখ্যার চৌদ্দ শতাংশ ছিলো তারা।
তাইওয়ানে যদিও সংগঠিত স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রায়নের জন্য চাপ বাড়ছিলো। কর্তৃত্ববাদী শাসনের নৈতিক বৈধতা কমছিলো, বিভিন্ন স্থানে চলছিলো গণতন্ত্রের পক্ষে বিক্ষোভ ও অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচি। ফলে, বাধ্য হয়েই চিয়াং কাই-শেকের পুত্র চিয়াং চিং-কু তাইওয়ানে গণতন্ত্রায়নের পথ।
তাইওয়ানে গণতন্ত্রের পথ-প্রদর্শক হিসেবে পরিচিত প্রেসিডেন্ট লি টেং-হিউ সাংবিধানিক পরিবর্তনের মাধ্যমে শাসনতান্ত্রিক বিবর্তন শুরু করেন, যার ফলশ্রুতিতে ২০০০ সালে তাইওয়ানে আসে কুমিটাংদের বাইরে প্রথম প্রেসিডেন্ট, প্রেসিডেন্ট চেন সুই-বিয়ান।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬১৫
আপনার মতামত জানানঃ