বাংলাদেশকে ‘ব্লক বা গোষ্ঠী রাজনীতি’ প্রত্যাখ্যান করে নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানিয়েছে চীন। দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত মাহবুবুজ্জামানকে গত বুধবার এ কথা বলেন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া বিষয়ক দফতরের মহাপরিচালক লিউ জিনসং।
তিনি বলেন, বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের দেশগুলো নিজেদের এবং আঞ্চলিক স্বার্থের কথা মাথায় রাখবে বলে বিশ্বাস করে চীন। তারা নিজেদের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে এবং স্নায়ু যুদ্ধ ও ব্লক রাজনীতির মনোভাব প্রত্যাখ্যান করবে।
এর আগে চীন প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার আঞ্চলিক জোট কোয়াডে যোগ না দিতে বাংলাদেশকে আহ্বান জানিয়েছিল। ওই আহ্বানের এক বছরের মাথায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সাথে এক বৈঠকে আবারো একই কথা বলল চীন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে চীনের নাক গলানো!
প্রসঙ্গত, ‘স্নায়ুযুদ্ধকালীন মানসিকতা ও ব্লক বা গোষ্ঠী রাজনীতি’ পরিহার করতে সম্প্রতি বাংলাদেশসহ আঞ্চলিক দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে চীন। একই সঙ্গে দেশগুলোকে নিজেদের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা ও সত্যিকারের বহুত্ববাদ সুরক্ষারও আহ্বান জানিয়েছে দেশটি।
গত বছরের মে মাসে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং প্রকাশ্যে বাংলাদেশকে কোয়াডে যোগ না দেয়ার কথা বলেছিলেন। ঢাকায় তিনি বলেন, এই চার দেশের জোটের সঙ্গে যুক্ত হওয়া বাংলাদেশের জন্য ভালো কোনো বিষয় নয়। কারণ, এটি বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সে সময় লি’র এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেন, চীনের দূতের এ ধরনের মন্তব্য ‘অত্যন্ত দুঃখজনক’ এবং ‘আক্রমণাত্মক’। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।
আমাদের পররাষ্ট্রনীতি আমরাই নির্ধারণ করবো। চীনের থেকে এ ধরনের আচরণ আমরা আশা করিনি।
প্রথম থেকেই কোয়াডের বিরোধিতা করছে চীন। দেশটি কোয়াডকে সামরিক জোট ন্যাটোর এশিয়ান সংস্করণ হিসেবে দেখছে। মাহবুবুজ্জামানের সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সর্বশেষ বক্তব্যের সমালোচনা করেন লিউ। ব্লিঙ্কেন সমপ্রতি দাবি করেন, চীন বিশ্বের একমাত্র দেশ যে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক, সামরিক এবং প্রযুক্তিগত ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে চায়। বৃহস্পতিবার যুক্তরারষ্ট্রভিত্তিক জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাইডেন প্রশাসনের চীন নীতি উন্মোচন করেন ব্লিঙ্কেন। এ সময় তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চীনই দীর্ঘ মেয়াদে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ, জোট তৈরির মাধ্যমে চীনকে মোকাবিলা করবে।
এর প্রেক্ষিতে লিউ বলেন, ব্লিঙ্কেনের বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে, বিশ্ব, বেইজিং এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুতর বিচ্যুতি হয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল অকাস, কোয়াড এবং সর্বশেষ ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনোমিক ফ্রেমওয়ার্ককে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্ট্রিজম’ এবং ‘এক্সসেপশনালিজম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বলেন, এ ধরণের আচরণ দেশটির নিজের জন্যেই অসম্মান বয়ে আনবে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এখানে যে আঞ্চলিক সহযোগিতার কাঠামো রয়েছে তা ধ্বংস করে দেবে এবং দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করবে। লিউ আরও বলেন, বিশ্বজুড়ে এক দেশের আধিপত্যের পক্ষে কোনো সমর্থন নেই, ব্লকভিত্তিক দ্বন্দ্বের কোনো ভবিষ্যৎ নেই এবং অল্প স্থানের জন্য উঁচু দেয়াল তৈরি ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
এবারও এর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু গণমাধ্যম এই বলে প্রচার ছড়াচ্ছে, বাংলাদেশ নিজের পররাষ্ট্রনীতি কীভাবে প্রতিপালন করবে, সে বিষয়ে চীন নসিহত করছে। এমন পটভূমিতে এটা বুঝে দেখা জরুরি, এমন আহ্বানের মাধ্যমে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়াবিষয়ক মহাপরিচালক লুই জিনসং আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন, চীন কেন আঞ্চলিক দেশগুলোকে ব্লক রাজনীতির ফাঁদে পা না দেওয়ার জোরালো আহ্বান জানিয়েছে এবং কোনো গ্রুপে না জড়িয়ে এসব দেশ কীভাবে নিজেদের স্বকীয় পরিচয় তুলে ধরবে।
চীনের এই পরামর্শের কারণ কী?
একুশ শতককে ‘দ্য এশিয়ান সেঞ্চুরি’ বা এশিয়ার শতক অভিহিত করার মধ্য দিয়ে এর কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকাকে তুলে ধরা হয়। মহাদেশটি তার ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও জনসংখ্যার গতিপ্রকৃতির মধ্য দিয়ে সে ভূমিকাই রাখতে যাচ্ছে। ফলে এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে চীনের গভীর বন্ধন ও এর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাব যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির মিত্রদের বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের ভয়, চীন বুঝি এই বন্ধনের মাধ্যমে ভূরাজনীতিতে বড় দাঁও মারতে যাচ্ছে।
চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে রাশ টেনে ধরতে ও নিজের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ঠান্ডা যুদ্ধের আবহ ছড়ানোর চেষ্টা করছে। এ কথা অস্বীকার করার জো নেই যে এ অঞ্চল ঘিরে তিন জোট—ট্রান্স–প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি), ইন্দো–প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) ও ইন্দো–প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (আইপিইএফ) প্রমাণ করে—যুক্তরাষ্ট্র শীতল যুদ্ধকালীন মানসিকতার মধ্যে আছে। এই তিন জোটেরই নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র এবং তিন জোট থেকেই চীনকে কৌশলে বিযুক্ত রাখা হয়েছে। যেমনটা প্রথম স্নায়ুযুদ্ধকালে করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
একইভাবে তারা এখন এশীয় দেশগুলোকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চাপ দিচ্ছে তাদের পক্ষভুক্ত হতে। ভূরাজনৈতিক এ উত্তেজনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষভুক্ত হওয়া মানে চীনের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখা।
উল্লিখিত বিশ্লেষণ এ কথা বোঝার জন্য যথেষ্ট যে ব্লক রাজনীতির ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি থেকে আঞ্চলিক দেশগুলো দূরে থাকুক—চীন কেন এটি চায়। উপরন্তু বহু কারণের কথাও বিবৃত করা যায়, কেন এ অঞ্চলে ‘ব্লক রাজনীতি’ চীন সমর্থন করে না। প্রথমত বলা যায়, যদি এশীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার নতুন স্নায়ুযুদ্ধের কোনো এক পক্ষ নেয়, তাতে পরিস্থিতি কেবল মারাত্মক আকারই ধারণ করবে না, আঞ্চলিক শান্তি ও সমৃদ্ধিও হুমকির মুখে পড়বে।
দ্বিতীয়ত, এই ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যদি এশীয় দেশগুলো শামিল হয়, তাহলে বিশ্ব আসলে দুটি পরস্পরবিরোধী গ্রুপে ভাগ হবে। অর্থাৎ এশিয়ার বাইরে বাকি বিশ্বের দেশগুলোরও এই দুই পক্ষের যেকোনো একটিতে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। অন্যদিকে মহাশক্তিধর দেশগুলো এখন যে অনড় অবস্থান ধরে রেখেছে, সেখান থেকে তারা তখনই নড়তে বাধ্য হবে, যখন কেউ কোনো ব্লকে শামিল হবে না।
তৃতীয়ত, যদি এশিয়ার দেশগুলো এই অর্থনৈতিক ও আদর্শিক সংঘাত থেকে দূরে থাকে, তাতে তাদের মধ্যকার বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় ঝুটঝামেলা মিটিয়ে ফেলা সহজ হবে।
চতুর্থত, প্রতিটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিকার রয়েছে তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবস্থান, উদ্দেশ্য নিজের মতো করে নির্ধারণ করার। যদি এশিয়ার দেশগুলো এ নতুন স্নায়ুযুদ্ধের পক্ষভুক্ত হয়ে পড়ে, তাহলে এসব বিষয়ে তাদের লক্ষ্য নির্ধারণ ও তা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। কেননা, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্লকের নেতৃত্বাধীন বিশ্বশক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়নই তখন মুখ্য হয়ে পড়বে।
পঞ্চমত, ঔপনিবেশিক শাসনে দীর্ঘদিন শোষিত হয়েছে এশিয়ার বেশির ভাগ দেশ। তখন থেকে তাদের আর্থসামাজিক নানা সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্লকের ফাঁদে পা দেওয়া মানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাববলয় অটুট রাখা।
ষষ্ঠত, সুনির্দিষ্ট কোনো আদর্শকে সমর্থন দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়; বরং বিশ্বে আরও সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় এসব দেশের একযোগে কাজ করা উচিত।
সপ্তমত, স্নায়ুযুদ্ধের মানসিকতা লালন না করে এশিয়ার দেশগুলোর উচিত হবে বৃহত্তর সহযোগিতায় আবদ্ধ হওয়া। যাতে দেশগুলো নিজেদের ভূমি, অভ্যন্তরীণ বাজার ও জনশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে।
অষ্টমত, এশিয়ার দেশগুলো যদি গ্রুপের চক্করে পড়ে, তাহলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা একদিন পূর্ণাঙ্গ সংঘাতে গড়াতে পারে, এমনকি তা হতে পারে পরমাণবিক যুদ্ধও। সে ক্ষেত্রে এশিয়াই সবচেয়ে বেশি ভুগবে, যেভাবে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এখন বেশি ভুগতে হচ্ছে ইউরোপকে।
এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলোর উচিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্যাটেলাইট স্টেট’ না হয়ে একসঙ্গে কাজ করে ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ নিশ্চিত করা। চীনের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে যুক্তরাষ্ট্র আসলে তার একক আধিপত্য ধরে রাখতে চায়। এ কারণেই ওয়াশিংটন চেষ্টা করছে এশিয়ার দেশগুলোকে ‘বলির পাঁঠা’ বানাতে। যুক্তরাষ্ট্র যে কৌশল গ্রহণ করেছে, তা এরই মধ্যে অনেকাংশে ভুল ও অনুপযুক্ত প্রমাণিত হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ইন্দো–প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির (আইপিএস) অর্থনৈতিক অসংগতি যুক্তরাষ্ট্রকে ইন্দো–প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (আইপিইএফ) গঠনে ধাবিত করেছে। আইপিইএফে যেহেতু কোনো অগ্রাধিকারমূলক বাজারে প্রবেশাধিকার কিংবা শুল্ক ছাড়ের সুবিধা নেই, তাই এটিও ব্যর্থ হওয়া সময়ের ব্যাপার।
যুক্তরাষ্ট্রের মনে রাখা উচিত, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে নেওয়া যে কৌশল ইউরোপে কাজে দিয়েছে, একই কৌশল এশিয়ায় চীনের বিরুদ্ধে খাটবে না। কেননা, ভূরাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক দিক থেকে এশিয়া ও ইউরোপ আলাদা।
‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পাঁচ নীতি’ মেনে ১৯৫৪ সাল থেকে চীন তার পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ‘নাক না গলানো’র চর্চা জারি রেখেছে। চীন এটা খুব ভালোভাবেই বোঝে, যদি এই অঞ্চলের দেশগুলো ব্লক রাজনীতিতে যুক্ত হয়, তাহলে নতুন স্নায়ুযুদ্ধ আরও তীব্র হবে। কেননা, সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা শুরু হওয়া মানে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ঝুঁকিতে পড়া, নিরাপত্তা ব্যাহত হওয়া। ফলে জনগণের স্বস্তি দূর হবে, তাদের জীবন আরও কঠিন হয়ে পড়বে। দীর্ঘ মেয়াদে শান্তি ও সমৃদ্ধির খাতিরে ব্লক রাজনীতির মানসিকতা থেকে দূরে থাকতে চীন তাই আঞ্চলিক দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/০৭২৩
আপনার মতামত জানানঃ