জিরাফের গলা ৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে৷ জিরাফের কশেরুকা সংখ্যায় মানুষের মতোই সাতটি হলেও আকারে বেশ লম্বা৷ মস্তিষ্কে রক্ত পৌঁছাতে জিরাফের হার্টকে প্রায় দুই মিটার ওপরে পাম্প করতে হয়।
জিরাফ তার লম্বা গলার জন্য পরিচিত, যেটা দিয়ে সে অনেক উঁচু গাছের পাতা খেতে পারে৷ কিন্তু হয়তো খাদ্যের প্রয়োজনে নয় জিরাফের গলার বিবর্তন হয়েছে যৌনতার জন্য৷
মধ্যযুগের বেশ কিছু চমৎকার তত্ত্ব আছে এই বিষয়টি নিয়ে৷এতে বলা হয়েছে চিতাবাঘ আর উটের সংকর হলো জিরাফ৷ অন্য তত্ত্বগুলো বলছে, গ্রিক পৌরাণিক গল্পে যে কাইমেরার কথা বলা হয়েছে সেই প্রাণীর একটা ধরন এটি, অথবা চীনা পৌরাণিক গল্পে পরিচিত কিলিন প্রাণীর একটি ধরন হলো জিরাফ৷
চার্লস ডারউইন বলেছেন, জিরাফের গলা লম্বা হওয়া বিবর্তনএবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের উদাহরণ৷ তিনি বলেছেন, এই প্রাণীর গলা লাখ লাখ বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে লম্বা হয়েছে, যাতে তারা খাদ্যের উৎস, যেমন উঁচু গাছের ডালপালা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে৷
কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা একটি ভিন্ন তত্ত্ব দিয়েছেন৷তারা বলছেন, যৌনকর্মই জিরাফের গলা লম্বা হওয়ার কারণ৷ তারা এর নাম দিয়েছেন ‘নেকস ফর সেক্স’৷ তারা বলছেন, যৌনতার প্রতিযোগিতার সময় পুরুষ জিরাফেরা গলাকে ব্যবহার করত৷
নতুন একটি গবেষণা প্রতিবেদন বলছে,তারা যেসব তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করেছেন, তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে, যৌন সঙ্গী নির্বাচনের ভয়াবহ যুদ্ধে টিকে থাকার প্রয়োজনে জিরাফের গলা বিবর্তিত হয়ে এত লম্বা হয়েছে৷
ডিস্কোকেরিক্স জিহি নামে নতুন একটি প্রাণীর ফসিল গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন৷ এই প্রাণীটি ১ কোটি ৬৯ লাখ বছর আগের৷ ধারণা করা হচ্ছে জিরাফের প্রাথমিক রূপ এটি৷ এটি জিরাফয়েড নামেও পরিচিত৷ এদের মাথা ও গলার জোড়ার গড়ন ভীষণ জটিল যা আজ পর্যন্ত কোন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায়নি৷
পুরুষ জিরাফয়েডের গলা ভীষণ লম্বা এবং শক্তিশালী, যা দিয়ে খুব সহজেই প্রতিদন্দ্বীকে ঘায়েল করা যায় এবং মাদি জিরাফের সাথে মিলিত হওয়া যায়৷ এক কোটি ১০ লাখ বছর ধরে জিরাফের গলা বিবর্তিত হয়েছে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের৷
যাই হোক, লম্বা গলার এই জিরাফের সংখ্যা কিন্তু সম্প্রতি কমেছে৷ সংরক্ষণবাদীরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে নীরব বিলুপ্তির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে অতিকায় এই প্রাণি৷ সাব-সাহারান আফ্রিকায় জিরাফের সংখ্যা এখন ৯৭ হাজার ৫০০৷ আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়ন বলছে এ সংখ্যা ১৯৮৫ সাল থেকে প্রায় ৪০ শতাংশ কম৷
নানা ধরনের বিপদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে রাজকীয় এই প্রাণিকে৷ রোগ, বাসস্থান হারানো, এমনকি রাস্তা পেরোতে গিয়ে গাড়ি বা বিদ্যুতের তারের সঙ্গে ধাক্কাও রয়েছে এই তালিকায়৷ সম্প্রতি আফ্রিকায় শিকারের ট্রফি হিসেবে জিরাফের কদর বেড়েছে৷ এই শিকারিদের বেশিরভাগই আসেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে৷ আফ্রিকায় এখন হাতির চেয়ে জিরাফের সংখ্যা কম৷
২০১৬ সালে গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন নতুন এক তথ্য৷ আগে জিরাফের একটিই প্রজাতি আছে বলে মনে করা হলেও নতুন গবেষণা বলছে, জিরাফের আছে চার ধরনের প্রজাতি৷ এই চার প্রজাতির মধ্যে তিনটিই আছে অস্তিত্বের হুমকিতে৷
জিরাফের গর্ভাবস্থাও তাদের গলার মতোই লম্বা, প্রায় ১৫ মাস৷ মা জিরাফ দাঁড়িয়ে সন্তান জন্ম দেয়, ফলে পৃথিবী আগমনেই বড়সড় একটা ধাক্কা খেতে হয় শিশু জিরাফকে৷ জন্মের পরপরই প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু থেকে মাটিতে পড়ে শিশু জিরাফ৷ তবে শিশু জিরাফ সবকিছু শিখতে পারে খুব দ্রুত৷ জন্মের আধা ঘণ্টার মধ্যে দাঁড়ানো শিখে যায়, মার সাথে দৌড়ানো শুরু করে ঘণ্টা দশেকের মধ্যে৷
জিরাফ মোটামুটি সারাক্ষণই খেতে থাকে৷ প্রতি সপ্তাহে শতশত কেজি পাতা খেতে হয়, আর তাই খাদ্যের সন্ধানে ভ্রমণও করতে হয় বড় এলাকায়৷ গাছের পাতা খাওয়া সহজ হলেও, পানি খাওয়াটা বেশ ঝক্কির এবং বিপদজনক৷ দুই পাশে পা ছড়িয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে তাদের পানি খেতে হয়৷ সুতরাং মাঝেমধ্যেই কুমিরের মতো প্রাণিদের সহজ শিকারে পরিণত হয় জিরাফ৷ তবে কয়েকদিনে একবার পানি খেলেই বেশ চলে যায় জিরাফের৷ লতাপাতা থেকেই বেশিরভাগ পানি পেয়ে যায় তারা৷
পুরুষ জিরাফ নিজের এলাকায় কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য অপর পুরুষ জিরাফের সাথে লড়াই করে। লড়াই এর সময় তারা অস্ত্র হিসেবে লম্বা গলা ব্যবহার করে তাই একে Necking বলে। এটি দুই প্রকার হতে পারে। স্বল্প প্রবল লড়াই এর ক্ষেত্রে তারা শুধু গলা গলা লাগিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে। যে বেশি উপরে গলা রাখতে পারে সে বিজয়ী হয়। কিন্তু প্রবল লড়াই এর ক্ষেত্রে তারা গলা পেন্ডুলামের মতো নাড়িয়ে একে অপরকে আঘাত করে। এসব লড়াই এর ক্ষেত্রে প্রায়ই ঘাড় ভাঙ্গা, মাথা ফেটে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। কিছু ক্ষেত্রে তা মৃত্যু পর্যন্ত গড়ায়।
জিরাফ নিয়ে আশ্চর্যজনক কিছু তথ্য
- জিরাফের গলার এক একটি হাড় প্রায় ১১ ইঞ্চি লম্বা। জিরাফের সার্ভাইকাল ভার্টিব্রি (Cervical vertebrae) সংখ্যায় ৭ টি।
- এরা নিজের নাক ও নাকের ছিদ্র বন্ধ করতে পারে। যাতে পোকামাকড় ভিতরে ঢুকে না যায় ও ধূলিঝড়ের সময় এটি সুরক্ষা প্রদান করে।
- জিরাফ দিনে ৪-৬ ঘন্টা ঘুমায়। কিন্তু কিছু প্রানীবিদের মতে বন্য পরিবেশে জিরাফ দিনে প্রায় ৫-৩০ মিনিট ঘুমায়। সাধারণত বসে ঘুমালেও এদের দাঁড়িয়ে ঘুয়ানোর রেকর্ড ও আছে।
- কোনো মহিলা জিরাফ প্রজননের জন্য প্রস্তুত কিনা তা বোঝার জন্য পুরুষ জিরাফ মহিলার মূত্র চেটে দেখে।
জিরাফের ত্বকের উপর আলাদা আলাদা ছোপ থাকে। এইসব ছোপ অনেকটা ফিংগারপ্রিন্টের মতো। কারণ প্রত্যেক জিরাফের ছোপ আলাদা ও কারো সাথে কারো ছোপের প্যাটার্ন মিলবে না। - জিরাফ তৃণভোজী হলেও এরা মাঝে মাঝে মরদেহের হাড়ের উপর থেকে মাংস চেটে খায়।
- এরা কয়েকদিন পরপর একবার পানি খায়। দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পানি এরা পাতা থেকেই পায়।
- জিরাফ প্রায় ৩০ মাইল প্রতি ঘণ্টা বেগে দৌড়াতে পারে।
সবচেয়ে লম্বা জিরাফের উচ্চতা ছিলো ১৯.৩ ফুট। - জিরাফ সাধারণত ৩৮ বছর বেচে থাকে যা অন্যান্য রুমিন্যান্ট প্রাণীর চেয়ে বেশী।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬১৩
আপনার মতামত জানানঃ