মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর নিবন্ধন নবায়ন না করায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ। এ নিয়ে শুক্রবার(১০ জুন) জেনেভায় একটি বিবৃতি দিয়েছেন সংস্থাটির মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি।
এছাড়া অধিকারের নিবন্ধন বাতিল করায় বাংলাদেশ সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ ১১টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছে অধিকারের নিবন্ধন নবায়নের আহ্বান জানিয়েছে।
পরিষদের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার দেশটির বিশিষ্ট ও সম্মানিত মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের নিবন্ধন নবায়নের আবেদন অনুমোদন না করায় আমরা উদ্বিগ্ন’।
নবায়নের শর্ত পূরণ করতে না পারার কথা তুলে ধরে ‘অধিকার’র নিবন্ধন নবায়ন আবেদন নামঞ্জুর করার কথা জানিয়েছে এনজিও ব্যুরো।
জেনেভায় রাভিনা বলেন, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অবশ্যই জাতিসংঘকে সহযোগিতা করায় নিরুৎসাহিত করা যাবে না। বাংলাদেশ সরকার অধিকারের নিবন্ধন নবায়ন না করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই যাতে এই সিদ্ধান্ত এখনই পুনরায় বিবেচনায় আনা হয়।
তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সাল থেকেই অধিকার ভয়ভীতি এবং প্রতিহিংসার শিকার। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এর কার্যক্রমের পেছনে নজরদারি বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতিসংঘকে সহায়তা করায় অধিকার গত এক দশক ধরে যে প্রতিশোধের শিকার হয়েছে তা নিয়ে উদ্বেগ জানান রাভিনা।
এছাড়া অধিকারের নিবন্ধন নবায়ন না করা নিয়ে আলাদা আলাদা বিবৃতি দিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। পাশাপাশি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছে মোট ১১টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা।
অধিকারের নিবন্ধন বাতিল নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, এমন সিদ্ধান্তের অর্থ হচ্ছে, মানবাধিকার রক্ষায় যারা কাজ করে তাদের কণ্ঠ রোধ এবং ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা চলছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের সম্পর্কে তথ্য রাখা এর বিচারের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
অ্যামনেস্টি আরও বলেছে, মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের রেকর্ড খুব দুর্বল। আর এ কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েছে। মানবাধিকার নিয়ে তথ্য প্রকাশ করার কারণে ‘অধিকারের’ নিবন্ধন নবায়ন না করার বিষয়টিকে হাস্যকর বলে উল্লেখ করেছে মানবাধিকার সংস্থাটি।
বাংলাদেশ সরকার অধিকারের নিবন্ধন নবায়ন না করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই যাতে এই সিদ্ধান্ত এখনই পুনরায় বিবেচনায় আনা হয়।
অ্যামনেস্টির দাবি, অধিকার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে তাই সরকার সংগঠনটির উপরে ক্ষুব্ধ। অবিলম্বে সংগঠনটির কাজের অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে অ্যামনেস্টি।
সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ক্যাম্পেইনার সাদ হাম্মাদি এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশে অপরাধীদের তাদের অপরাধের জন্য চিহ্নিত করার জন্য অধিকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ক রিপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এই রিপোর্টের কারণে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ায় অধিকারের নিবন্ধন ৮ বছর আটকে রাখার পর বাতিল করে দেয়া অযৌক্তিক। অধিকারের বিরুদ্ধে এমন প্রতিশোধ বাংলাদেশের মানবাধিকারের রক্ষকদের স্তব্ধ এবং সাবধান করে দেয়ার এক জঘন্য এবং নির্লজ্জ চেষ্টা।
তিনি আরও বলেন, সরকার বা রাষ্ট্রের দায়িত্ব মানবাধিকার সংগঠনগুলো যে ধরনের তথ্য বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রকাশ করে, সেই অভিযোগগুলোকে যথাযথ এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে জনসমক্ষে তুলে ধরা। অধিকারের নিবন্ধন বাতিল করার অর্থ হলো মানবাধিকার এবং মানবাধিকার কর্মীদের প্রতি একটি ভয়ঙ্কর আগ্রাসনের লক্ষণ। তিনি বাংলাদেশ সরকারকে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে অধিকারসহ অন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়ার আহ্বান জানান। সাদ হাম্মাদি বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে রিপোর্ট করা মোটেই সরকারবিরোধী কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ নয়।
২০১৫ সালের ২৫ মার্চ এনজিও ব্যুরোতে অধিকারের নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এর কয়েক মাস আগে ২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তারা নিবন্ধন নবায়নের আবেদন করে।
আট বছর পর ওই আবেদন নিষ্পত্তির কথা জানিয়ে রোববার এক চিঠিতে এনজিও ব্যুরো বলে, ‘বৈদেশিক অনুদান রেগুলেশন আইন ২০১৬-এর ধারা ৪ (৪) মোতাবেক সংস্থা কর্তৃক দাখিলকৃত নবায়নের আবেদনপত্রে অসংগতি থাকা, সময় সময় চাহিত তথ্যাদির সঠিক জবাব/ব্যাখ্যা ও কাগজপত্র দাখিল না করা এবং রাষ্ট্রের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে এমন কাজে সম্পৃক্ত থাকার কারণে সংস্থার কার্যক্রম সন্তোষজনক না হওয়ায় ’অধিকার’ নামীয় সংস্থাটির নিবন্ধন নবায়নের আবেদনটি বিবেচনার সুযোগ নাই’।
ওই চিঠিতে অধিকারের সব হিসাবের লেনদেন বন্ধ রাখতে স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংককেও চিঠি দিয়েছে এনজিও ব্যুরো।
এর পাঁচ দিন পর শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের বিবৃতিতে নিবন্ধন নবায়ন না করায় উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি অধিকারের অ্যাকাউন্ট সচল করারও আহ্বান জানানো হয়েছে।
২০১৩ সালে ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ ভণ্ডুলের অভিযান নিয়ে ’অধিকার’ প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে তখন ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল।
সেদিনের যৌথ অভিযানে ৬১ জন নিহত হয় বলে দাবি করেছিল অধিকার; যদিও সরকারের ভাষ্য, সেই রাতের অভিযানে কেউ মারা যায়নি।
এরপর অধিকারের সম্পাদক শুভ্র ও পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আদিলুরকেও ওই সময় গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। এখন মামলার দুই আসামি আদিলুর ও এলান জামিনে রয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিগত এক দশকে দেশ এমন অবস্থার সাক্ষী যেখান থেকে গণতন্ত্র ক্রমেই সরে গেছে। এমন এক শাসনব্যবস্থার সাক্ষী হয়েছে, যা গণতন্ত্রের যেকোনো রূপ থেকেই অনেক দূরে। ক্ষমতাসীনরা বলপ্রয়োগের ওপরেই আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। দেশ শাসনে এখন বলপ্রয়োগের বাহিনীগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে। বিগত দুই নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহির বিষয়টি অনেক দূরে চলে গেছে। যদিও এগুলোকে ‘নির্বাচন’ বলা যায় কি না, তাও একটি প্রশ্ন।
আরও বলেন, সুষ্ঠূ ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জবাবদিহির যে প্রক্রিয়া, তা যখন কার্যত অবসিত হয়েছে, তখন আরও বেশি দরকার হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে জবাবদিহির চেষ্টা করা। কিন্তু, গুমের বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) কথা বলতে পারার ব্যর্থতার মাধ্যমেই জবাবদিহি না থাকায় তৈরি হওয়া সংকটের গভীরতা বোঝা যায়।
তারা বলেন, গুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার সময়ে এটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার যে, গুমের বিষয়টি শাসনব্যবস্থা ও জবাবদিহির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত; আর এটা খুব স্পষ্টভাবে বলা যে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৯
আপনার মতামত জানানঃ