একটা সময় ছিলো যখন মানুষ বনে জঙ্গলে, পাহাড়ের গুহায় বাস করতো। তখন সময় নির্ণয়ের জন্য মানুষের অবলম্বন ছিল সূর্য। সূর্য উঠলে দিন শুরু হতো, আর ডুবে গেলে রাত। পরে মানুষ যখন বুঝতে শিখলো, তখন তারা দেখলো প্রতিদিন সূর্য একটা নির্দিষ্ট পথে চলাচল করে। সেই থেকে মানুষ সূর্যের উদয় আর অস্ত যাওয়া থেকে সময়ের হিসাব করা শিখলো।
এরপর তারা দেখলো, সূর্যের আলোতে যা ছায়া পড়ে তা একটা নির্দিষ্ট যায়গায় কখনো স্থির থাকে না। দিন বাড়ার সাথে সাথে ছায়াও সরে যায়। মানুষ তখন মাটিতে কোনো বস্তুর ছায়ার বিভিন্ন অবস্থান চিহ্নিত করতে লাগলো। মাটিতে দাগ কেটে কিংবা পাথর সাজিয়ে ছায়ার চিহ্ন রাখা হতো। সাধারণ এই পদ্ধতিটির উদ্ভাবন থেকেই মানব ইতিহাসে প্রথম ঘড়ির জন্ম হলো।
আদিম যুগের মানুষকে শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সবসময় সতর্ক থাকতে হতো। তাই রাতে ছিল পালাক্রমে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা। আর কার পরে কে পাহারা দেবে সেটা ঠিক করার জন্যই আদিম যুগের মানুষেরা রাতকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে নিয়েছিলো। রাতের এই একেকটি অংশকে বলা হতো ‘ওয়াচ’।
ছয় হাজার বছর আগে প্রাচীন মিশরীয় সাম্রাজ্যে সমস্ত দিনকে ১২ ঘন্টায় ভাগ করা হয়েছিল। এছাড়া খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০০ অব্দে চীনারাও একইভাবে সময়ের ভাগ করেছিল। গ্রীকদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল দিন ও রাতকে ১২ ঘন্টায় ভাগ করার এই পদ্ধতি।
খ্রিস্টীয় তেরো শতকে প্রথম সমান সময়ের ঘণ্টার হিসাব চালু করা হয়। মিশরীয় গণিতজ্ঞ আবু হাসান এই প্রথা চালু করেন। তিনিই প্রথম দিনকে সমান ১২ ঘন্টায় ভাগ করে নেন। ফলে দিন-রাত মিলে মোট ২৪ ঘন্টার প্রচলন হয়।
এরপর আস্তে আস্তে প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে নানা ধরনের ঘড়ির আবির্ভাব হতে থাকে। সেই প্রাচীনকালের সূর্যঘড়ি থেকে আজকের আধুনিক স্মার্ট-ওয়াচ। চলুন ঘুরে আসা যাক ঘড়ির বিবর্তনের এই অদ্ভুত ইতিহাস থেকে।
ঘড়ির ব্যবহার সর্বপ্রথম শুরু হয় সূর্যঘড়ি বা Sundial এর মাধ্যমে। কবে সর্বপ্রথম এই সূর্যঘড়ি আবিষ্কার হয়েছিল তা জানা যায়নি। তবে সবচেয়ে প্রাচীন যে সূর্যঘড়ি পাওয়া যায় তা খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ অব্দে মিশরে নির্মিত হয়।
সূর্যঘড়ির গঠন খুব সাধারণ। এতে একটি লম্বা কাঁটা বা নির্দেশক থাকে। এটি এমনভাবে একটি ডায়ালের সাথে লাগানো থাকে যাতে কাঁটাটির ছায়া ডায়ালটিতে পড়ে। ডায়ালটির গায়ে বিভিন্ন ঘন্টা ও মিনিট নির্ণয়ের জন্য চিহ্ন দেওয়া থাকে। দিনের বিভিন্ন সময়ে কাঁটাটির ছায়া ডায়ালের বিভিন্ন স্থানে পড়তো। এই ছায়া থেকে সময় নির্ণয় করা হতো।
পৃথিবীর বহু দেশে এই সূর্যঘড়ির প্রচলন ছিল। ছোট থেকে শুরু করে বিশাল আকৃতির হতো এই সূর্য ঘড়ি। কিছু ছোট সূর্যঘড়ি ছিলো যা মানুষ পকেটে কিংবা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারতো। আবার কিছু বিশাল আকৃতির সূর্যঘড়ি বানানো হয়েছিলো রাস্তার ধারে কিংবা পার্কে। যাতে মানুষ সহজে সময় জানতে পারে। যেমন, প্যারিসের ‘লুক্সর অবেলিক্স’ নামের বিশাল আকৃতির সূচালো চারকোণা স্তম্ভটি একটি সূর্যঘড়ি।
কিন্তু এ ঘড়ির কিছু সমস্যা থাকার কারণে মানুষ নতুন ঘড়ি আবিষ্কারের চেষ্টা করতে থাকে। সূর্য ঘড়ির অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল, এই ঘড়ি রাতের বেলা ব্যবহার করা যেত না। এছাড়া মেঘলা দিনেও এই ঘড়ি অচল হয়ে পড়তো। তাই আঠারো শতকের দিকে এ ঘড়ির ব্যবহার আস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে।
প্রাচীনকালে সূর্যঘড়ির পাশাপাশি প্রচলন ছিল জলঘড়ির। ধারণা করা হয় প্রায় ৫০০০ বছর আগে চীনদেশে জলঘড়ি বা Clepsydra -এর প্রচলন ছিল। অনেকে আবার মনে করেন মিশরে এই ঘড়ির প্রথম প্রচলন হয়।
জলঘড়ির গঠনও ছিলো সরল আকৃতির। প্রথমে একটি পাত্রে পানি রাখা হতো। এই পাত্রটির নিচে থাকতো একটি ফুটো। এই ফুটো দিয়ে নিচের আরেকটি পাত্রে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়তো। নিচের পাত্রটিকে ২৪ ভাগে ভাগ করা থাকতো। নিচের পাত্রটিতে কতটুকু পানি জমা হলো তা থেকে নির্ণয় করা হতো সময়। এছাড়াও ভারত মহাদেশে আরেক ধরণের জলঘড়ি প্রচলিত ছিল। এটিতে একটি বড় পানি ভর্তি পাত্রের উপর একটি ছোট ফুটোযুক্ত ধাতব পাত্র ভাসিয়ে দেওয়া হতো। ছোট পাত্রটি ভারি হওয়ায় তাতে আস্তে আস্তে পানি প্রবেশ করতো। এই ছোট পাত্রটির ভিতরের দিকে ঘণ্টা নির্দেশক দাগ দেওয়া থাকতো। এই দাগ থেকে সময় নির্ণয় করা হতো। পরে খাঁজকাটা চাকা যুক্ত জলঘড়িরও প্রচলন হয়।
পৃথিবীর বহুদেশে এই জলঘড়ি জনপ্রিয়তা পায়। এটিতে সূর্যঘড়ির মত অসুবিধা ছিলো না, ফলে এটি দিনে-রাতে ব্যবহার করা যেত ও যেকোনো স্থানে বহন করা যেত। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতে এই জলঘড়ি ব্যবহৃত হতো। আমাদের দেশে রাজধানী ঢাকা সহ দেশের অন্যান্য শহরেও জলঘড়ি ও সূর্যঘড়ির প্রচলন ছিলো।
তবে এত সুবিধা থাকার পরেও জলঘড়ির কিছু অসুবিধা ছিলো। এই ঘড়ি জাহাজে ব্যবহার করা যেত না। এছাড়া শীতপ্রধান দেশগুলোতে এ ঘড়ি ছিলো অচল। কারণ এ ঘড়ির পানি জমে বরফে পরিণত হলেই ঘড়ি বন্ধ হয়ে যেত। ফলে মানুষ এই জলঘড়ির বিকল্প খোঁজা শুরু করে।
এসডব্লিউ/এসএস/২১১৫
আপনার মতামত জানানঃ