অর্থপাচারের তথ্য পেতে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়ে প্রত্যাখ্যাত বাংলাদেশ। সে দেশের ব্যাংকগুলোতে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবে সাড়া দিচ্ছে না সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অধিকাংশ সময় তাদের কাছে তথ্য চেয়েও তার সবটা পাওয়া যায়নি। মাত্র দুটি ইস্যুতে সুইস ব্যাংক কিছু তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশকে, তাও আবার অনির্দিষ্ট।
সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার জন্য বারবার আগ্রহ দেখালেও তারা সাড়া দিচ্ছে না। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে বাংলাদেশি নাগরিকদের জমা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। সুইস সরকারের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এতে অর্থ পাচারকারীদের কারো নাম উল্লেখ নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নামে-বেনামে টাকা থাকায় প্রকৃত হিসাব এর অনেক বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও বিকাশের ক্ষেত্রে অর্থপাচার এক ভয়াবহ সংকট। বছরে দেশ থেকে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে বলে দাবি করেন শীর্ষ অর্থনীতিবিদগণ। এই টাকা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সরকার কথা বললেও কাজ হচ্ছে খুব কমই। অর্থ উদ্ধারের কৌশল ঠিক করার দায়িত্ব যে আমলাদের, আবার তারাও অর্থপাচারের জন্য দায়ী। বিশ্লেষকরা ধারণা করেন, আমলারা নিজেদের বাঁচাতে অর্থ ফেরত আনার পদ্ধতি নির্ধারণে বিঘ্ন ঘটাচ্ছেন। এর মধ্যেই জানা গেল, সুইস ব্যাংক সাড়া দিচ্ছে না বাংলাদেশের আহবানে। বৈদেশিক অর্থ-বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছাই পারে আমলাতন্ত্রের বাধা পেরিয়ে এই সঙ্কটের সমাধান ঘটাতে।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ৬৮টি দেশের সঙ্গে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনাসহ সন্ত্রাসী অর্থায়ন কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে চুক্তি করেছে। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে পারেনি। সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা অর্থের ব্যাপারে কোনো তথ্য সংগ্রহ না করতে পারার অন্যতম কারণ এটি। রাজনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া এ সংকট সমাধান সম্ভব নয়। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে সৎ ও নিরপক্ষেদের সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ের বিশেষ নিয়ন্ত্রক কমিটি দরকার, যারা আমলাতান্ত্রিক বাধাসহ অন্যসব সংকট মোকাবিলা করে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেবেন। কিন্তু বারবার আহ্বান সত্ত্বেও সেরকম কোনো পদক্ষেপে সরকারের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াবাংলাদেশ থেকে বিদেশে কোনো অর্থ নেয়া যায় না। সুইজারল্যান্ডে অর্থ নেয়ার ব্যাপারেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অদ্যাবধি কাউকে অনুমতি দেয়া হয়নি। এছাড়া বিদেশে যারা আয় করেন বা প্রবাসী হিসেবে যারা বিদেশে আছেন তাদের আয় থেকে সঞ্চয়ের অংশ দেশে আনার বিধান রয়েছে। এগুলো দেশে না আনলে পাচার হিসেবে ধরে নেয়া যায়।
গেল অক্টোবর মাসে প্রণীত বিএফআইইউ-এর এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, রফতানি আয় দেশে না এনে এবং আমদানির ব্যয় বেশি দেখিয়ে সুইজারল্যান্ডে অর্থ পাচার করা হয়েছে। এসব অর্থ ফেরত আনার জন্য ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের কাছে চিঠি দেয়। এতে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের কার কার টাকা জমা আছে তার তালিকা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে কোনো সাড়া দেয়নি।
এর পরের বছর ২০১৪ সালেও একই ধরনের চিঠি দেয়া হয়েছিল। এতেও সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাড়া দেয়নি। ফলে ওই বছর সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর (এমওইউ) করার জন্য তৎকালীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ থেকে চিঠি দেয়া হয়। এতেও সাড়া মেলেনি। ওই সময়ে বিভাগটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে ছিল। পরে এটি বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট নামে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। এরপর থেকে বিএফআইইউ এসব বিষয় দেখভাল করছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমদ বলেন, বিদেশ থেকে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনার বিষয়ে সবার আগে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এরপর পদ্ধতিগতভাবে এগোতে হবে। তাহলে সুফল পাওয়া যাবে। এখন মানি লন্ডারিং আইনের কারণে সুইস ব্যাংকও তথ্য দিচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারত ও আমেরিকাকে তারা অনেক তথ্য দিয়েছে।
জানতে চাইলে বিএফআইইউর একজন কর্মকর্তা জানান, সুইস ব্যাংক সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য না দিলেও অনেক দেশ এখন বাংলাদেশকে তথ্য দিচ্ছে। তবে একজন ব্যবসায়ীর অর্থ সম্বন্ধে সুনির্দিষ্টভাবে দুই দফা জানার চেষ্টা করা হলে তারা জানিয়েছিল যে, ওই ব্যক্তির নামে সুইস কোনো ব্যাংকে কোনো অর্থ এই। এমনিতে সুইস ব্যাংকে কেউ যদি ভিন্ন কোনো দেশের পাসপোর্ট বা বাংলাদেশের বেনামি কোনো পাসপোর্ট নাম্বার দিয়ে সুইস ব্যাংকগুলোতে অর্থ জমা রাখেন তবে সেগুলো বের করা কঠিন। এ কারণে হয়তো সুইস ব্যাংকে টাকা জমা থাকলেও তার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি জানান, অর্থপাচার প্রতিরোধ ও পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার করতে হলে টাকার গন্তব্য সম্পর্কে জানতে হবে। এজন্য সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। একই সঙ্গে যেসব দেশ বিশেষ করে ভারত ও আমেরিকা কিভাবে সুইজারল্যান্ড থেকে তথ্য পেল তাদের গৃহীত কৌশল সম্পর্কে জেনে সে পথে এগোনোর কথা বলা হয়েছে।
এসডাব্লিউ/ডিজে/আরা/১০০০
আপনার মতামত জানানঃ