চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৪৯ থেকে ৪১-এ নামিয়ে এনেছে প্রশাসন। তবে ডিপো কর্তৃপক্ষ, প্রত্যক্ষদর্শী ও হাসপাতালে ভর্তি আহত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে শোনা গেছে, ভয়াবহ এই বিস্ফোরণে আসলে কতজন নিহত হয়েছেন; তা হয়তো কখনোই জানা যাবে না। সচেতন মহল প্রশ্ন তুলছেন, প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা নিয়েও।
নিহতের হিসেবে ভুল
গত রোববার (৫ জুন) চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী জানান, তাদের হিসাব অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা ৪৯ জন। দূর্ঘটনাস্থল বিএম কনটেইনার ডিপোতে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকেও একই সংখ্যা জানানো হয়।
কিন্তু গতকাল সোমবার (৬ জুন) দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত মরদেহ পাওয়া গেছে ৪১ জনের। তাই নিহতের সংখ্যাও- ৪১।’
এ বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, ‘ওটা আমাদের যোগ করতে ভুল হয়েছিল। বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন আহত শ্রমিক ও লাশ উদ্ধার করেছে। আমাদের কোনো কর্মকর্তা বিষয়টি দেখভাল করেনি। তাই অংকের হিসেবে ভুল হয়েছে। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ৪১ জনের মরদেহ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।’
গণসংহতি আন্দোলন রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য ও জেলা সমন্বয়ক হাসান মারুফ রুমী বলেন, “মানুষের মৃত্যুর যোগফলে যারা ভুল করে- তারা কিভাবে দায়িত্ব পালন করেন! আসলে মরদেহ ওদের কাছে একটা সংখ্যা ছাড়া কিছুই নয়। তাদের এই দ্বিচারীতা মানুষের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে; মনে হচ্ছে তারা সত্য বলছেন না।”
দমকল কর্মী নিহতের হিসেবেও গরমিল
সোমবার সকালে ঘটনাস্থলে আসা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের ৯ কর্মী বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন, এখনও নিখোঁজ আছেন ৩ জন। চিকিৎসাধীন ১৫ জনের মধ্যে ১ জন সুস্থ হয়ে স্টেশনে ফিরেছেন। চিকিৎসাধীনদের মধ্যে চট্টগ্রাম সিএমএইচে আছেন ১২ জন এবং অন্য ২ জন ঢাকায় শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন।’
তবে আগুনের খবর পেয়ে সবার আগে ঘটনাস্থলে পৌছানো কুমিরা ও সীতাকুণ্ড স্টেশন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা ১২ জন।
কুমিরা ফায়ার স্টেশনের অফিসার মঈন উদ্দিন জানান, তাদের ১৫ জনের একটি টিম আগুন নেভাতে বিএম কনটেইনার ডিপোতে যায়। এদের মধ্যে ৭ জন নিহত হয়েছেন, ৭ জন চিকিৎসাধীন ও ১ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
অপরদিকে, সীতাকুন্ড ফায়ার স্টেশনের অফিসার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বিস্ফোরণে তাদের ৫ জন কর্মী নিহত হয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন ৪ জন। একজনের ডেডবডি পাওয়া গেছে, তিনি হয়তো এই ৪ জনের যেকোনো একজন হবেন। কিন্তু তা এখনো তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’
সোমবার সকালেও মিলেছে দেহবাশেষ
অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত বিএম কনটেইনার ডিপোতে সোমবার সকাল ৯টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিস ও সেনা বাহিনীর সদস্যরা ডিপোর বিভিন্ন অংশে মৃতদেহের সন্ধান করছেন।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লা ফায়ার সার্ভিসের কর্মী আব্দুল হক বলেন, ‘কনটেইনারের ভেতরে পানি প্রবেশ করানো যাচ্ছে না। তাই আমরা বাইরে থেকে পানি ছিটাচ্ছি। এসময় নিহত মানুষের কিছু দেহাবশেষ পাওয়া গেছে।’
পরে বেলা সাড়ে দশটার দিকে সাংবাদিকদের ডিপো এলাকা থেকে বের করে দিয়ে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত কনটেইনার ও আশপাশের এলাকা পরিস্কার করা হয়।
সে সময় উপস্থিত স্থানীয় বাসিন্দা মো. আজাদকে বলতে শোনা যায়, ডিপো যদি এভাবে পরিস্কার করে ফেলা হয়, তাহলে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা কখনই জানা যাবে না। তিনি বলেন, বিস্ফোরণে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের ড্রামসহ নানান জিনিস এক মাইল দূরে গিয়ে পড়েছে। বাড়িতে থেকেই আমার মেয়ের মাথা ফেটে গেছে।
এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই ঘটনাস্থলে থাকা মানুষের শরীরের পুরোটা পাওয়া যাবে; তা কীভাবে হয়! তাই নিহতদের দেহবাশেষ সংরক্ষণ করলে, নিহতের সঠিক সংখ্যা পাওয়া যাবে।
নিহতের সংখ্যা বাড়তে পারে
বিএম কনটেইনার ডিপোর মালিক পক্ষের সহযোগী প্রতিষ্ঠান চিটাগং ডেনিম এর জিএম (এডমিন) শামসুল হায়দার চৌধুরী বলেছেন, ‘ডিপোতে যারা কর্মরত ছিলেন তাদের অনেককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একারণে ডিপোতে থাকা আমাদের কতজন শ্রমিক আসলে নিহত হয়েছেন; তা জানা যায়নি।”
সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর কর্মী রুয়েল আহমদ বলেন, ’এই ডিপোতে দুই হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। দুর্ঘটনার সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অন্তত একশ গাড়ির আড়াইশ চালক-হেলপারও ঘটনাস্থলে অবস্থান করছিলেন। যেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত তার পাশেই আবার কর্মকর্তারা থাকতেন। ওই দিকে এখনও ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেনি। তাই নিহতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।’
সীতাকুণ্ড উপজেলার কেশবপুর এলাকার বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনার পর হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। পরে যাকে যেভাবে পেরেছি (উদ্ধার করে) হাসপাতালে পাঠিয়েছি। রোববার গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের সদস্যদের সঙ্গে মোট ১৩টি মরদেহ আমি উদ্ধার করেছি। এটা ছিল- ডিপোর মাত্র কিছু অংশে। বাকি অংশে আরও মৃতদেহ থাকবে এটা নিশ্চিত।
“বিশেষ করে এখানে যারা কাজ করতো তাদের অধিকাংশ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের। তাই স্বাভাবিকভাবে সবার স্বজনরা হয়তো জানেনই না তার স্বজন আর নেই।”
দুর্ঘটনায় নিখোঁজ মোহাম্মদ ইয়াছিন নামে এক চালকের বাবা বদিউল আলম আজ সিআইডির বুথে ডিএনএ টেস্টের স্যাম্পল দেওয়ার জন্য এসেছিলেন। তিনি বলেন, “ঘটনার দিন বিকেলে ডিপোতে গাড়ি নিয়ে ঢুকেছিল আমার ছেলে। সে সময় ফোনে কথা হয় তার সাথে। কিন্তু রাতে দুর্ঘটনার খবর শোনার পর তাকে বার বার ফোন করেও পাইনি।”
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, “এত বড় একটি দুর্ঘটনায় কতজন নিহত হয়েছে সে হিসাবের যোগফলে পুরো প্রশাসন ভুল করবে এটা কি মেনে নেওয়া যায়! তাহলে পুলিশ, জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ কী? এর আগেও বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দেওয়ার ঘটনা আমরা দেখেছি।”
এদিকে, অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় আহতদের ১৫ জন শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের বেশির ভাগের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। সোমবার শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ এ তথ্য জানিয়েছে।
অপরদিকে, বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের রেজিস্টার ডা. লিটন পালিত বলেন, “প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি হওয়া রোগীদের ১৭ জনের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। এসব রোগীর যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে
এসডব্লিউ/এসএস/১০১৬
আপনার মতামত জানানঃ