শনিবার রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারি এলাকার একটি কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৯ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। হতাহতদের মধ্যে ডিপোর কর্মীদের পাশাপাশি পুলিশ সদস্য ও ফায়ার সার্ভিস কর্মী রয়েছেন। জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াস চৌধুরী মৃতের সংখ্যা নিশ্চিত করেছেন।
শনিবার রাত ১১টার দিকে ভাটিয়ারিতে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। এতে রাসায়নিকের অনেকগুলো কনটেইনার একসঙ্গে বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণে আশেপাশের বেশ কয়েকটি ভবনের জানালা ভেঙে যায়। ৪ কিলোমিটার দূরের এলাকা থেকেও বিস্ফোরণের ধাক্কা টের পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।
আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন সিকদার গত রাতে জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ২১ সদস্য আহত হন।
সিএমসিএইচ পুলিশ ফাঁড়ির এসআই আলাউদ্দিন তালুকদার বলেন, ‘ডিপো থেকে ১৫টি অ্যাম্বুলেন্স ও গাড়িতে করে ১০০ জনের বেশি আহতকে চমেকে আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫০ জনকে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে।”
আহত আরও ২০ জন শ্রমিককে পার্কভিউ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আহত কয়েকজনকে চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ও অন্যান্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার জানান, ‘অধিকাংশ রোগী সামান্য দগ্ধ হয়েছেন। তাদের চিহ্নিত করে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে আরও পাঁচ শ্রমিকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।’
নিহতদের মধ্যে মমিনুল হক (২২) বিএম কনটেইনার ডিপোর কম্পিউটার অপারেটর। তার বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায়।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন চট্টগ্রামের সব সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসককে দ্রুত সিএমসিএইচে আসার নির্দেশ দিয়েছেন।
শাহালাম নামে একজন আহত গাড়িচালক বলেন, ‘আমি মালামাল আনলোড করতে ডিপোতে গিয়েছিলাম। আকস্মিক বিস্ফোরণে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। পরে কী হয়েছে, মনে করতে পারছি না।’
এদিকে বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তৈরি পোশাক মালিকদের প্রায় ১ হাজার টিইইউ’স (২০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনার) কনটেইনার পণ্য পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএর সহসভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী। এর মধ্যে প্রায় ৯০০ টিইইউ’স যুক্তরাষ্ট্রগামী ও ১০০ টিইইউ’স ইউরোপগামী। এসব পণ্য রপ্তানির জন্য এই ডিপোতে আনা হয়েছিল। এছাড়া পুড়ে যাওয়া কনটেইনারে সুইডেন ভিত্তিক কোম্পানি এইচঅ্যান্ডএম-এর পণ্যও ছিল বলে জানান তিনি।
বিএম কনটেইনার ডিপোতে প্রায় ৬০০ শ্রমিক কাজ করেন। ৩০ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত ডিপোটির কনটেইনার ধারণক্ষমতা ৬ হাজার ৫০০ টিইইউ’স।
কনটেইনার ডিপোতে বিষ্ফোরণের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগে ২০২০ সালে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকার একটি ডিপোতে তেলের ট্যাংক বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও তিনজন।
বাংলাদেশে ১৯টি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) রয়েছে। এগুলো প্রায় শতভাগ রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডেল করে। এছাড়া ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্যও ডেলিভারির জন্য নিয়ে আসা হয় এসব ডিপোতে। এসব ডিপোর কনটেইনার ধারণ সক্ষমতা প্রায় ৭৭ হাজার টিইইউ’স কনটেইনার।
কিছুক্ষণ পরপর বিস্ফোরণের শব্দ
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসংলগ্ন সীতাকুণ্ডের শীতলপুর এলাকায় ৭০ কানি জায়গার ওপর কনটেইনার ডিপোটি অবস্থিত।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালে নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের যৌথ মালিকানায় ডিপোটি চালু হয়। আমদানি-রপ্তানি করা বিভিন্ন পণ্য এই ডিপোতে রাখা হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, ডিপোর ভেতরে ৫০০ মিটারের একটি টিনের শেড রয়েছে। এই শেডের টিনের পুরো অংশ উড়ে গেছে। বাতাসে উড়ছে ছাই। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে টিনের ভাঙা অংশ।
কিছুক্ষণ পরপর শোনা যাচ্ছে বিস্ফোরণের শব্দ। শেডের আশপাশ ঘুরে দেখা যায়, কোথাও আগুন জ্বলছে। কোথাও ধোঁয়া উড়ছে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে পুরো এলাকা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ডিপোর শ্রমিক সুপারভাইজার মোহাম্মদ মহসিন প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাত সাড়ে নয়টার দিকে বিস্ফোরণের পর ডিপোতে আগুন ধরে যায়। ডিপো থেকে শ্রমিকদের বের করে দিতে সঙ্গে সঙ্গে বাজিয়ে দেওয়া হয় সতর্কঘণ্টা। তবে সব শ্রমিক বের হতে পারেননি বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ডিপোর শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫০০ মিটার শেডের ভেতরে হাইড্রোজেন পারক্সাইড নামে একটি কেমিক্যাল রয়েছে। এগুলো বিদেশে রপ্তানি করা হয়। রপ্তানির জন্য হাটহাজারীর ঠান্ডাছড়ি কারখানায় উৎপাদিত কেমিক্যাল কনটেইনারে করে এই ডিপোতে রাখা হয়।
ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপপরিচালক আনিসুর রহমানকে আজ সকালে ডিপোর গেটের সামনে তাঁর লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। তিনি ঘটনাস্থলের বিভিন্ন তথ্য নিচ্ছিলেন।
জানতে চাইলে আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কনটেইনার ডিপোটিতে হাইড্রোজেন পারক্সাইড নামের কেমিক্যাল বিপুল পরিমাণে রয়েছে। তবে ঠিক কী কারণে বিস্ফোরণ ঘটল, তা এখনো জানা যায়নি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে। কিন্তু কাছাকাছি যাওয়া যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরপর ভেতর থেকে বিস্ফোরণের শব্দ আসছে।
আনিসুর রহমান আরও বলেন, চট্টগ্রামের পাশাপাশি কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী ফায়ার সার্ভিসের ২৩টি ইউনিটের ১৮৩ জন কর্মী আগুন নেভাতে কাজ করছেন। আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার পর ক্ষয়ক্ষতিসহ আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে জানা যাবে।
যেভাবে আগুনের সূত্রপাত
বেসরকারি কনটেইনার ডিপো মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, একটি হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ভর্তি রপ্তানি কনটেইনার থেকে আগুনের সূত্রপাত।
তবে বিএম কনটেইনার ডিপোর পরিচালক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আগুনের সূত্রপাত কোথা থেকে, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে কনটেইনার থেকেই আগুন ধরেছে বলে ধারনা করছি। আমরা হতাহতদের পাশে থাকব। আহতরা যাতে সর্বোচ্চ চিকিৎসা পায় সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার আমরা বহন করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ দুর্ঘটনায় যারা হতাহত হয়েছেন, তাদেরকে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। পাশাপাশি সকল হতাহতের পরিবারের দায়িত্ব নেয়া হবে। প্রশাসন যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবে, সেভাবেই সহায়তা করা হবে।’
পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রথমে বিএম কনটেইনার ডিপোর লোডিং পয়েন্টের ভেতরে আগুনের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়ে কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রথমে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে এক কনটেইনার থেকে অন্য কনটেইনারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। একটি কনটেইনারে রাসায়নিক থাকায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটনা ঘটে। এতে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, স্থানীয় শ্রমিকসহ দগ্ধ হন শতাধিক।
শনিবার মধ্যরাতে বিএম কনটেইনার ডিপোর পরিচালক মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, কী কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে কনটেইনার থেকেই আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করছি আমরা।
তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ডে হতাহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবো আমরা। আহতরা যাতে সর্বোচ্চ চিকিৎসা পায়, সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দুর্ঘটনায় যারাই হতাহত হয়েছেন, তাদের সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। পাশাপাশি হতাহতের পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া হবে।
ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ডিপোতে আমদানি-রফতানির বিভিন্ন মালামালবাহী কনটেইনার ছিল। ডিপোর কনটেইনারে রাসায়নিক ছিল, বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। দ্রুত চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ায় আহত হয়েছেন বেশি। আহতদের উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ