সম্প্রতি একজনকে ঘুমন্ত অবস্থা থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) র্যাব-৮ এর বিরুদ্ধে। নির্যাতিত ব্যক্তির নাম সজীব সরদার এবং তিনি ছাত্রলীগের একজন কর্মী বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের গৈলা বাজার সংলগ্ন প্রভাতী ভবনে মঙ্গলবার রাতে অভিযান চালিয়ে সজীব সরদার নামে একজনকে আটক করে র্যাব-৮ এর একটি দল। র্যাব দাবি করেছে, আটক যুবকের বাসায় তল্লাশি চালিয়ে ৩৯০ পিস ইয়াবা, একটি ওয়ান শুটারগান, শুটারগানের দুটি কার্তুজ জব্দ করা হয়েছে। এরপর তার বিরুদ্ধে র্যাবের ডিএডি আনসার আলী বাদী হয়ে অস্ত্র ও মাদক আইনে পৃথক দুটি মামলা দিয়ে থানায় সোপর্দ করেন।
তবে সজীব সরদারের মা নাসরিন জাহান বলেন, র্যাব যখন আমার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়, তখন আমরা ভেবেছি ঈদের আগের একটি মারামারির ঘটনায় হয়তো তাকে আটক করতে পারে। র্যাব বলে যায়, সকাল ৮টায় আগৈলঝাড়া থানায় যোগাযোগ করতে। কিন্তু সারা দিন অপেক্ষা করার পর সন্ধ্যায় থানায় নিয়ে আসে। যখন সজীবকে থানায় নিয়ে আসা হয়, তখন তার জ্ঞান ছিল না।
তিনি আরও বলেন, আমার ছেলের কোনো দিন শ্বাসকষ্ট ছিল না। অথচ থানায় তাকে ইনহেলার দিয়ে শ্বাস নিতে হয়েছে। দুই হাঁটু থেকে রক্ত ঝরছিল। বিভিন্ন স্থানের চামড়া তুলে ফেলেছে। কনুই দুটি ফুলে গেছে। থানায় চারবার বমি করেছে। আমার ছেলের শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে নির্যাতন চালায়নি র্যাব।
নাসরিন বেগম আরও বলেন, আপনারা দেখেছেন আমার পুত্রবধূ বরিশাল আদালত চত্বরে পবিত্র কুরআন শরীফ নিয়ে গিয়েছিল। সে বলেছে, যে বিছানার চাদরের নিচ থেকে অস্ত্র, মাদক উদ্ধার দেখিয়েছে, তা আমার পুত্রবধূ প্রতিদিন পরিষ্কার করে। তাহলে ঘরে অস্ত্র, গুলি ও ইয়াবা এল কোথা থেকে? সম্পূর্ণভাবে চক্রান্ত করে, ষড়যন্ত্র করে আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে।
র্যাবের ওই দিনের অভিযানের বিষয়ে গ্রেপ্তার সজিবের স্ত্রী সৈয়দা নওরীন জাহান মৌ বৃহস্পতিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের কাছে তার স্বামীকে ফাঁসানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে সৈয়দা নওরীন জাহান মৌ বলেন, সোমবার (৩০ মে) রাত সাড়ে ১২টার দিকে আমি, আমার পরিবার ও দুই সন্তানকে নিয়ে বাসায় ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলাম। এ সময় বেশ কয়েকজন লোক আমার বাসার দরজা খুলতে বলে। আমি খুলে দেখি ২৫/৩০ জনের একটি দল। আমি জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে আমরা র্যাব। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করি আপনার বাসায় কেন আসছেন, কিন্তু তারা কোনো উত্তর দেয়নি। পরবর্তীতে আমার স্বামী মো. সজিব সরদারকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। তারা আমাকে বলে মঙ্গলবার সকাল ৮টার সময় থানায় যোগাযোগ করবেন। থানায় যোগাযোগ করলে থানা কর্তৃপক্ষ বলে তারা এ বিষয়ে কিছু জানে না।
মৌ বলেন, যখন আমার স্বামীকে বাসা থেকে তুলে নেয় তখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ ও তার সঙ্গে কোনো কিছু পায়নি র্যাব। বুধবার আমরা জানতে পারি, তাকে আগৈলঝাড়া থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। পরে আমি ও আমার পরিবার থানায় গিয়ে দেখি সজিবের শরীরে বিভিন্ন স্থানে ফুলা, জখম ও রক্তাক্ত এবং দুই হাঁটুতে ব্যান্ডেজ। আমি থানা কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসা করলে তারা আমাকে বলে আপনার স্বামীর সঙ্গে অস্ত্র, ইয়াবা পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাকে ছাড়া যাবে না।
আমার ছেলের কোনো দিন শ্বাসকষ্ট ছিল না। অথচ থানায় তাকে ইনহেলার দিয়ে শ্বাস নিতে হয়েছে। দুই হাঁটু থেকে রক্ত ঝরছিল। বিভিন্ন স্থানের চামড়া তুলে ফেলেছে। কনুই দুটি ফুলে গেছে। থানায় চারবার বমি করেছে। আমার ছেলের শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে নির্যাতন চালায়নি র্যাব।
তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, এলাকার কতিপয় সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী, চোর-বাটপার মিলে বিপুল পরিমাণ টাকা দিয়ে র্যাব দ্বারা আমার স্বামীকে ধরিয়ে তার ওপর অমানুষিক অত্যাচার-নির্যাতন করে তাকে পঙ্গু করে দিয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমি আমার স্বামীর মুক্তি চাই। আর যারা তাকে ফাঁসিয়েছে, যে সব মামলা দিয়েছে তার সঠিক তদন্ত চাই। যাতে এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার হয়।
এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
জানা গেছে, আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের গৈলা বাজার সংলগ্ন প্রভাতী ভবনে সোমবার (৩০ মে) মাঝরাতে অভিযান চালিয়ে সজিব সরদার নামে একজনকে আটক করে র্যাব-৮ এর একটি টিম। র্যাব দাবি করেছে, আটক যুবকের বাসায় তল্লাশি চালিয়ে ৩৯০ পিস ইয়াবা, একটি ওয়ান শুটার গান, শুটার গানের দুটি কার্তুজ জব্দ করা হয়। এরপর আটকের বিরুদ্ধে র্যাবের ডিএডি আনসার আলী বাদী হয়ে অস্ত্র ও মাদক আইনে পৃথক দুটি মামলা দিয়ে থানায় সোপর্দ করে।
এ-সংক্রান্ত একটি পোস্ট র্যাব-৮ বরিশালের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হলেও তা বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে না।
আগৈলঝাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম ছরোয়ার বলেন, তার বিরুদ্ধে ৫/৬টি মামলা চলমান। তাকে আটক করতে গেলে কিছুটা ধস্তাধস্তি হয়ে আহত হতে পারেন। তবে থানায় তাকে কোনো ধরনের মারধর করা হয়নি।
এদিকে বুধবার (২ জুন) সন্ধ্যায় আসামি সজিব সরদারকে বরিশাল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সোপর্দ করা হলে বিচারক মো. মনিরুজ্জামান তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সজিবকে বহনকারী পুলিশের পিকআপটি বাধা দেন স্বজনরা। এ সময়ে তারা সড়কে শুয়ে পড়েন। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) লোকমান হোসেন বলেন, আদালত প্রাঙ্গণে স্বজনরা ওই আসামিকে জেলহাজতে পাঠানোর সময় পুলিশি ভ্যান আটকে দিচ্ছিল খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সজিবকে থানায় নিয়ে আসার পর র্যাব কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তাকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো গত কয়েক বছর ধরে গুম-খুন সহ নানা অভিযোগ তুলে ধরছিলো র্যাবের বিরুদ্ধে। কক্সবাজারে কাউন্সিলর একরাম হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর তা নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছিল আন্তর্জাতিক মহলে। তারও আগে নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে অপহরণের পর হত্যার ঘটনায় র্যাবের ১৬ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় আদালত যা এখনো উচ্চ আদালতে বিচারাধীন আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিচারবহির্ভূত নির্যাতন-হত্যাকাণ্ড হচ্ছে বিচারিক প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড। সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি কোনো অপরাধ করলে সে তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবে, সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে পারবে। এটি তার মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেখানে বিচারের আগেই আইনের তোয়াক্কা না করে অভিযুক্তকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হতে হচ্ছে, প্রাণ দিতে হচ্ছে।
তারা বলেন, বিগত এক দশকে দেশ এমন অবস্থার সাক্ষী যেখান থেকে গণতন্ত্র ক্রমেই সরে গেছে। এমন এক শাসনব্যবস্থার সাক্ষী হয়েছে, যা গণতন্ত্রের যেকোনো রূপ থেকেই অনেক দূরে। ক্ষমতাসীনরা বলপ্রয়োগের ওপরেই আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। দেশ শাসনে এখন বলপ্রয়োগের বাহিনীগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে। বিগত দুই নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহির বিষয়টি অনেক দূরে চলে গেছে। যদিও এগুলোকে ‘নির্বাচন’ বলা যায় কি না, তাও একটি প্রশ্ন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৬
আপনার মতামত জানানঃ