সম্প্রতি টাঙ্গাইল কারাগারে এক নারী কয়েদির মৃত্যুর অভিযোগে উঠেছে। সুচিকিৎসার অভাবে ওই কয়েদির মৃত্যু হয়েছে দাবি করে নিহতের স্বামী টাঙ্গাইল কারাগারের জেল সুপারসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে টাঙ্গাইল আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছেন। গত মঙ্গলবার(৩১ মে) সন্ধ্যায় টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাবে আসামিদের বিচারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ওই নারী কয়েদির পরিবার।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ওই নারী কয়েদির মেয়ে সোনালী আক্তার বলেন, তার মা নাদীয়া জাহান শেলী ডায়াবেটিক ও কিডনি রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এরপরও সখীপুর আমলি আদালতে চলমান মামলায় তিনি ছিলেন ২নং আসামি। গত ৪ঠা এপ্রিল অসুস্থ অবস্থায় তার মা অন্য একটি মামলায় সখীপুর আমলি আদালতে উপস্থিত হয়ে জামিন প্রার্থনা করেন। জামিনের জন্য আদালতে শারীরিক অসুস্থতার সকল রিপোর্ট দাখিল করার পরও বিচারক তার জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণ করেন।
নাদীয়া জাহান শেলী অসুস্থ হওয়ায় তার সুচিকিৎসার জন্য জেল সুপারকে নির্দেশ দেন বিচারক। কিন্তু জেল সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ও ডেপুটি জেলারসহ অজ্ঞাতনামা অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার চিকিৎসার সুব্যবস্থা না করে আদালতের নির্দেশ অমান্য করে তাকে সাধারণ কয়েদি হিসেবে জেনারেল ওয়ার্ডে রাখেন। চিকিৎসা না পেয়ে তিনি কারাগারে খুবই কষ্ট করেছেন। অবশেষে গত ৮ই এপ্রিল রাতে তিনি চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেন।
এরই প্রেক্ষিতে গত ১৯শে এপ্রিল তার বাবা মিনহাজ উদ্দিন বাদী হয়ে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট টাঙ্গাইল সদর থানা আমলি আদালতে মামলা দায়ের করেন। বিচারক পুলিশ সুপারকে মামলার ঘটনার বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন। সংবাদ সম্মেলনে নিহতের পাঁচ বছরের জমজ দুই ছেলে হাসান ও হোসাইন এবং মেয়ে সোনালী আক্তার উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে জেলা সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, কারাগারের ২ জন চিকিৎসক নাদীয়া জাহান শেলীর সুচিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন। কারাগারে তাকে সুচিকিৎসাই দেয়া হয়েছে। তিনি মারা যাওয়ার পর সকল প্রকার আইনি প্রক্রিয়া শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মরদেহ নেয়ার সময় তাদের কোনো অভিযোগ ছিল না। এরপরও তারা চিকিৎসার অভাবে ওই কয়েদির মৃত্যু হয়েছে দাবি আর আমাদের আসামি করে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।
বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চললেও এটির উন্নতিতে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো কাজ হয়নি।
এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত এক কয়েদির মৃত্যু হয়েছে। গত ২০ মে ভোরে কারাগারের ভেতরে তার মৃত্যু হয়।
মৃত নুরুল ইসলাম (৩৮) আখাউড়া উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রামের সৈয়দ আলীর ছেলে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগার ও সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত এক মাস আগে মাদক মামলায় দেড় বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারে আসেন নুরুল ইসলাম। ২০ মে ভোরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারে হঠাৎ অচেতন অবস্থায় দেখতে পান অন্য কয়েদি ও হাজতিরা।
পরে কারাগার কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা তাৎক্ষণিক তাকে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক নুরুল ইসলামকে মৃত ঘোষণা করেন।
এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারের মেজবাহ উদ্দিন (৫৬) নামে এক সাজাপ্রাপ্ত কয়েদির মৃত্যু হয়েছে। গত ৭ মে সন্ধ্যায় ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তারও আগে মাদারীপুরে কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত এক কয়েদির মৃত্যু হয়েছে। গত ৩ মে বিকেলে কারাগারের ভেতরে তার মৃত্যু হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চললেও এটির উন্নতিতে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো কাজ হয়নি। চিকিৎসক এবং অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রীর অপ্রতুলতার কারণে কারাগারে এর আগেও বন্দি মারা গিয়েছে।
তারা বলেন, ১৮৯৪ সালের প্রিজন অ্যাক্টের ১৩ ধারা মতে, একজন বন্দির পূর্ণ চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। একজন মেডিক্যাল অফিসার প্রতি ২৪ ঘণ্টা অন্তর বন্দিদের শারীরিক পরীক্ষা ছাড়াও তাদের নানা অসুস্থতা সম্পর্কে জানার কথা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে যে, বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে বিষয়টি সর্বক্ষেত্রে মানা হয় না। এদিকে ১৮৬৪ সালের জেলকোড বন্দিদের চিকিত্সা পাওয়ার ক্ষেত্রে দারুণ ব্যবস্থা রেখেছে।
এ বিধান অনুযায়ী, কোনো বন্দি অসুস্থ হলে প্রহরীরা সঙ্গে সঙ্গে হেড ওয়াড্রেনকে জানানোর কথা রয়েছে। তিনি সাব-অ্যাসিসট্যান্ট সার্জনকে বন্দির অসুস্থতা সম্পর্কে জানাবেন। এরপর অ্যাসিসট্যান্ট সার্জন সঙ্গে সঙ্গে বন্দির ওয়ার্ড ভিজিট করবেন। বন্দির অবস্থা বুঝে তাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করার কথাও বলা হয়েছে ১৮৬৪ সালের জেলকোডে। এ বিষয়ে তিনি জেলার এবং মেডিক্যাল অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন। বাংলাদেশের জেলখানায় এ নিয়মগুলো মানা হয় না বলে অনেকের অভিযোগ।
বর্তমান সরকারের আমলে কারাগারে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিশেষ করে বিরোধী বা ভিন্নমতের মানুষের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটছে। এর দায় অবশ্যই সরকারকেই নিতে হবে। বলেন, কারাগারে মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৬
আপনার মতামত জানানঃ