সেনা অভ্যুত্থান-পরবর্তী সহিংসতার জেরে মিয়ানমারে প্রথমবারের মতো বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে বলে নিজেদের এক রিপোর্টে জানিয়েছে জাতিসংঘের কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্সের (ইউএনওসিএইচএ)।
জাতিসংঘের তরফে সতর্ক করে বলা হয়েছে, বর্ষা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে ক্ষোভ বাড়তে থাকায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
ইউএনওসিএইচএ বলছে, অভ্যুত্থানের পর সহিংসতার ঘটনায় ১২ হাজারের বেশি বেসামরিক লোকের সম্পত্তি জ্বালিয়ে দেওয়া বা নষ্ট করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে আশ্রয়শিবিরে থাকা এসব মানুষের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে উঠতে পারে বলে সতর্ক করছে সংস্থাটি।
এদিকে, সহিংসতার জেরে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের স্যাগাইন অঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন তিন লাখ মানুষ। সেখানে অহরহ জান্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে ওই অঞ্চলে ফোন সার্ভিস, খাবার, ওষুধ ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘ বলছে, ওই অঞ্চলগুলোতে জরুরিভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ করা প্রয়োজন। কিন্তু সংকট নিরসনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। জান্তা সরকার সেখানে মানবিক সহায়তা প্রস্তাবে রাজি নয়।
অভ্যুত্থানের আগেই বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষদের সঙ্গে নতুন করে সহিংসতার ঘটনায় আরও তিন লাখ ৪৬ হাজার বাস্তুচ্যুত যুক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে থাই ও চীন সীমান্তে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা এবং রোহিঙ্গা মুসলিমরাও রয়েছেন। ২০১৭ সালে এসব রোহিঙ্গাকে নৃশংস দমন-পীড়ন চালিয়ে তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দেশটির গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সুচির এনএলডি সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, এরপর দেশটির সাত লাখের বেশি মানুষকে তাদের ঘর ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।
অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দেশজুড়ে দল গঠন করেছে বেসামরিক মিলিশিয়ারা এবং জান্তা সরকার তাদের লক্ষ্য করে প্রায়ই আক্রমণাত্মক আচরণ করছে। ফলে গ্রামেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। বেসামরিক লোকদের ওপর বিমান হামলা করা হয়, এমনকি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও ঘটছে।
স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, অভ্যুত্থান–পরবতী সহিংসতায় এখন পর্যন্ত এক হাজার ৮০০ জন নিহত ও ১৩ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে আটক করেছে জান্তা সরকার।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী কি যুদ্ধে হারতে বসেছে?
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে সবশেষ সামরিক অভ্যুত্থানটি হয় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে দেশটির কুখ্যাত সেনাবাহিনী। এ অভ্যুত্থান ও অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে সর্বস্তরের জনতা। গড়ে তোলে অভ্যুত্থানবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন।
জনপ্রিয় এ আন্দোলন প্রতিহত করতে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করে জান্তা সরকার। কিন্তু এক বছর পরে এসে স্বঘোষিত সেই যুদ্ধেই হারতে শুরু করেছে তারা। এক্ষেত্রে দেশটির অভ্যুত্থানবিরোধী বাহিনীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে এ বছরের আবহাওয়া।
ভারতীয় উপমহাদেশের বেশিরভাগ দেশের মতোই মিয়ানমারও বহুদিন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে ছিল। সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৮ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর ১৯৬২ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতার স্থপতিদের মাধ্যমেই দেশটির শাসন পরিচালিত হয়।
এরপর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতার দখল নেয় সেনাবাহিনী। চলতি শতকের হাতেগোনা কয়েকটা বছর বাদ দিলে সেই থেকেই কার্যত সেনাবাহিনীই দেশ শাসন করে চলেছে।
কিন্তু এটাও সত্য যে মিয়ানমারের জনগণ কখনোই সেনাবাহিনীর এই দুঃশাসন মেনে নেয়নি। দশকের পর দশক ধরে কখনো রাজপথে আবার কখনো অস্ত্র হাতে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এক কথায়, সেনা ও জনতার মধ্যে এক চিরন্তন গৃহযুদ্ধ অব্যাহত।
মিয়ানমারে প্রতিবছর তীব্র গ্রীষ্ম শেষে আসে ঘন বর্ষা। সাধারণত মে মাসের শুরুতে দক্ষিণ-পশ্চিমের মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়, যা দেশটির গৃহযুদ্ধেও বেশ প্রভাব ফেলে। প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের ফলে লড়াইয়ের মাত্রা কমে আসে। আগের বছরগুলোর মতোই ঠিক এ বছরও ইতোমধ্যে দেশটির মধ্যাঞ্চলের বিস্তীর্ণ সমতলে ব্যাপক বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে।
গত বছরের সামরিক অভ্যুত্থানের পরপরই নেপিদোর জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তা একদিকে যেমন সংখ্যায় বেড়েছে, তেমনি অভিজ্ঞতায় আরও সমৃদ্ধ হয়েছে।
বিপরীতে নিজ দেশের বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে তাতমাদো (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল তা কার্যত রাজনীতির কানাগলিতে ঢুকে পড়েছে।
সেনা ও জনতার চলমান সশস্ত্র সংঘাত এমন এক জটিল পর্যায়ে প্রবেশ করেছে যেখান থেকে ফেরার কোনো পথ নেই বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। যার ফলে সামরিক শাসনের অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
সেনাবাহিনীর অবৈধ ক্ষমতা দখলের পরপরই মিয়ানমারজুড়ে যে আন্দোলন শুরু হয়, সরকারের নজিরবিহীন দমন-পীড়নের মুখে কয়েক সপ্তাহ পরই তা জান্তাবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে রুপ নেয়।
শুরুর দিকে এই লড়াই মন্থর ও মৃদু হলেও ক্রমশ তা জোরালো হয়ে ওঠে। চলতি বছরের গ্রীষ্মে দেশজুড়ে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়। যার ফলে লাখ লাখ বেসামরিক নাগরিক ভিটে-মাটিছাড়া হয়।
এর ফলে দুটি কঠিন বাস্তবতা সামনে এসেছে, যা সামনের মাসগুলোতে যুদ্ধ পরিস্থিতির রুপ বদলে দেবে। সেইসঙ্গে এর গতিপথও ঠিক করে দেবে। প্রথমত, জান্তাবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন সমূলে ধ্বংস করার লক্ষ্যে সমন্বিত অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। কিন্তু বিরোধীদের সমূলে ধ্বংস করা তো দূরে থাক, তাদের সামান্যতম ক্ষতিও করতে পারেনি।
প্রকৃতপক্ষে, অভিযানের নামে মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলজুড়ে নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। লুটপাট চালানো হয়েছে। এর ফলে বেসামরিক নাগরিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও জান্তাবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামকে তা আরও শক্তিশালী করেছে।
দ্বিতীয়ত, জান্তাবিরোধী লড়াই এগিয়ে নিতে যে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফস) গড়ে উঠেছিল, সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের ফলে দিনদিন তার সদস্য সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটি আরও বেশি সংগঠিত ও কিছু ক্ষেত্রে আরও উন্নত অস্ত্রসজ্জিত।
ক্ষমতাগ্রহণের এক বছরের মধ্যেই সরকার একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়েছে, অন্যদিকে কূটনৈতিকভাবে হয়েছে একঘরে। পরিস্থিতি মোকাবিলার সবচেয়ে ভালো উপায় হিসেবে আগামী বছরের শেষ দিকে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে এখন সেটার দিকেই নজর দিচ্ছে জান্তা কর্তৃপক্ষ।
তাদের লক্ষ্য, যেভাবেই হোক বেসামরিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু জান্তাবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধে যে মোড় নিয়েছে তা তাতমাদোর জন্য ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে না।
২০২১ সালের শেষ থেকেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও জান্তাবিরোধী প্রতিযোধ যোদ্ধাদের মধ্যে সহিংসতা শুরু হয়। যা চলতি বছরের পুরো গ্রীষ্মকালজুড়েই বিক্ষিপ্তভাবে দেখা গেছে। দেশের বিশাল একটা অংশজুড়ে ছোট ছোট সংঘর্ষ ও হামলার বিস্তৃতি ও মাত্রা এবং সেই সঙ্গে সম্মুখভাগ থেকে এই লড়াইয়ের নিরপেক্ষ প্রতিবেদনের অভাবে এর সংহত বিশ্লেষণ জটিল হয়ে পড়ে।
তবে দৈনন্দিন ঘটনাবলি তদারকির ফলে এটা স্পষ্ট যে, লড়াইয়ের বড় ক্ষেত্র ছিল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল পশ্চিম মিয়ানমারের সাগাইং ও ম্যাগউই এলাকা। উভয় অঞ্চলই ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী অং সান সুচির সমর্থকদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত, যা মধ্য মান্দালয় পর্যন্ত বিস্তৃত।
জাতিগত সংখ্যালঘু প্রতিরোধ যোদ্ধা নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমের চিন রাজ্য ও উত্তরে কাচিন রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোর পাশাপাশি সংঘাত হয়েছে মান্দালয়, মনিওয়া ও পাকোকুর ছোট ছোট শহরগুলোতেও। এসব অঞ্চলে ছোট-বড় শহরগুলোর কেন্দ্রের সেনাঘাঁটি থেকে গ্রামগুলোতে অভিযান চালায় তাতমাদোর সেনারা।
এই গ্রামগুলো জান্তাবিরোধী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস’র যোদ্ধাদের আশ্রয় দিচ্ছে বলে দাবি জান্তা কর্তৃপক্ষের। গ্রামগুলোতে ঘনঘন অভিযান চালিয়ে বহু গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়েছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এসব অভিযানের বেশিরভাগই ৫০ থেকে ১০০ সেনাবিশিষ্ট ছোট ছোট বাহিনীর মাধ্যমে চালানো হয়। এর সঙ্গে যোগ দেয় ‘পিই স হতে’ নামে পরিচিত স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদ্রোহী যোদ্ধাদের ঘাঁটি বা ক্যাম্প টার্গেট করে বিমান ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করেও হামলা চালানো হয়েছে।
বিপরীতে জান্তাবিরোধী লড়াইয়ে পিডিএফ যোদ্ধারা প্রাথমিকভাবে হাতে তৈরি বিভিন্ন আকারের বিস্ফোরকের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এর ফলে সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে কিংবা বেসামরিক নাগরিকদের সহায়তার ক্ষেত্রে প্রায়ই তাদেরকে পিছু হটতে হয়েছে।
ভিন্ন দৃশ্যপটে উন্নত অস্ত্র সজ্জিত যোদ্ধারা আগ্রাসী জান্তা সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গত বছরও মাত্র কয়েক মিনিট দাঁড়াতে পারত। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তাদের সেই সংঘাতের সক্ষমতা ও সময় অনেকে বেড়েছে। একটানা কয়েক ঘণ্টা লড়াই চালিয়ে যেতে পারে বিদ্রোহী যোদ্ধারা, যা যুদ্ধক্ষেত্রে একটা বড় পরিবর্তনের কথাই বলছে।
‘আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন’ (অ্যাকলেড) এবং ‘ইভেন্ট ডাটা প্রজেক্ট’ এর দেয়া তথ্য বলছে, সংঘবদ্ধ এসব হামলা গ্রাম থেকে শহুরে কেন্দ্রগুলো থেকেও পরিচালিত হচ্ছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শহরের মধ্য থেকে এ রকম হামলা আগে চোখে পড়েনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫৭
আপনার মতামত জানানঃ