বেশ কয়েকদিন ধরে বাজারে চড়া মূল্যে বিক্রি হচ্ছে ডলার। টাকার বিপরীতে ডলার সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৯৭-৯৮ টাকায়। ডলারের বিপরীতে টাকার মানের এমন বেহাল দশার একটা কারণই সামনে নিয়ে আসছে সরকার, সেটি আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কেবল আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির জন্যই ডলারের দাম আকাশচুম্বী হয়নি।
তবে এটাও সত্য যে দেশে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। আমদানির লাগাম টানতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপেও কাজ হচ্ছে না। এমনকি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে এলসি খোলার পরিমাণ।
লাগামহীন আমদানি
করোনা সংকট কেটে যাওয়ার পর থেকেই আমদানিতে উল্লম্ফন শুরু হয়। যা এখনও অব্যাহতভাবে বেড়েই চলেছে। এতে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের উপর চাপ পড়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৭ হাজার ৬৬৫ কোটি ১৫ লাখ (৭৬.৬৫ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা, যা গত অর্থবছরের পুরো সময়ের (২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন) চেয়েও ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি। আর একই সময়ের চেয়ে বেশি ৪৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
বর্তমান বিনিময় হার হিসেবে (প্রতি ডলার ৮৯ টাকা) টাকার অঙ্কে চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৬ লাখ ৮২ হাজার ১৮৫কোটি টাকার এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি। আর নতুন বাজেটের চেয়েও বেশি।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। ৯ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের যে বাজেট উপস্থাপন করবেন তার সম্ভাব্য আকার পৌণে ৭ লাখ কোটি টাকার মতো হবে বলে গণমাধ্যমে যে তথ্য এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার পণ্য আমদানির এলসি-সংক্রান্ত হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, এই ১০ মাসে গড়ে ৭ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে।
অস্বাভাবিক এই আমদানির লাগাম টেনে ধরতে বিলাস পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত এলসি মার্জিন আরোপসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও তেমন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বেড়েই চলেছে আমদানি। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। সামাল দিতে সবশেষ সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরেক দফা কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ দফায় এক ধাক্কায় টাকার মান ১ টাকা ১০ পয়সা কমিয়ে সব ব্যাংকের জন্য ডলারের একক দর ৮৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
ডলারের দাম বাড়ার দায় কার?
এ কথা অনস্বীকার্য যে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। বিশ্ববাজারে বেড়েছে পণ্যের দাম। কিন্তু এটিই একমাত্র কারণ নয়। করোনাসময়ে যেখানে হুন্ডি ব্যবসা একরকমের বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেটি এখন চলছে পুরোদমে। এতে দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে জ্বালানি তেল, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), ভোজ্যতেল, গমসহ অনেক পণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এতে পণ্য আমদানির খরচ বেড়ে গেছে। তবে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়ার সুযোগ নিয়ে ইনভয়েসিংয়ের (পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেখানো) বিদেশে টাকা পাচার করছে।
হুন্ডি ব্যবসা ও বিদেশে টাকা পাচারের কারণে আমদানি ব্যয়ের ধাক্কা সামলানো গেলেও দুর্নীতি ও অনিয়মের তোপে কমানো যাচ্ছে না ডলারের দাম।
এদিকে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ও হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হয়ে ওঠায় চাপ পড়েছে রাষ্ট্রের রিজার্ভে। এ ছাড়া আমদানি ব্যয় বাড়ায় সৃষ্টি হতে পারে বাণিজ্য ঘাটতি।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম প্রথম সারির এক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, চলতি হিসাবে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে এবার ৩০ বিলিয়ন বা তিন হাজার কোটি ডলার ঘাটতি হতে পারে। হুন্ডি বেড়ে যাওয়ায় রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় দিয়ে এই ঘাটতি পোষানো যাবে না। ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট বা মূলধনি হিসাব আমলে নিলেও বছর শেষে ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি ডলারের ঘাটতি থেকে যাবে বলে আশঙ্কা করছি।
২০০১ সালে আমাদের রিজার্ভ ১৯০ কোটি ডলারে নেমে গিয়েছিল। সেখান থেকে বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত আমাদের রিজার্ভ ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। এরপর কমার প্রবণতা শুরু হয়েছে। মাঝে রিজার্ভ ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলারে নেমে আবার ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।
রিজার্ভ থেকে ৬০০ কোটি ডলার বিক্রি
মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মঙ্গলবারও ১২ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। এর ফলে রিজার্ভ কমে ৪২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে (২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩১ মে) প্রায় ৬০০ কোটি (৬ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বিপরীতে বাজার থেকে ৫৩ হাজার কোটি টাকার (প্রতি ডলার ৮৯টাকা) বেশি তুলে নেয়া হয়েছে।
বাজারে চাহিদার তুলনায় ডলারের সরবরাহ কম। সে কারণে প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আন্তব্যাংক দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সামাল দিতে সবশেষ সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরেক দফা কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ দফায় এক ধাক্কায় টাকার মান ১ টাকা ১০ পয়সা কমিয়ে সব ব্যাংকের জন্য ডলারের একক দর ৮৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দরে ডলার কেনাবেচা করলেও সাধারণ মানুষের কাছে নগদ ডলার বিক্রি করছে সাড়ে ৪ টাকা থেকে ৭ টাকা বেশি দরে। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে বিক্রি হচ্ছে আরও বেশি দামে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক মঙ্গলবার ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। জনতা ব্যাংক থেকে ১ ডলার কিনতে লেগেছে ৯৩ টাকা ৯০ পয়সা। অগ্রণী ব্যাংক বিক্রি করেছে ৯৩ টাকা ৫০ পয়সায়।
বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক থেকে ১ ডলার কিনতে লেগেছে ৯৬ টাকা। প্রাইম ব্যাংক নিয়েছে ৯৫ টাকা। খোলাবাজারে প্রতি ডলার ৯৭ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
অস্থির বাজারে ১৭ মে খোলাবাজারে ডলারের দর ১০০ টাকা ছাড়িয়ে ১০৪ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। ১৮ মে ১০০ টাকার বেশি দরে কার্ব মাকেটে ডলার বিক্রি হয়। ১৯ মে অবশ্য ডলারের দর ১০০ টাকার নিচে নেমে এসে ৯৬ টাকা ২০ পয়সা থেকে ৯৬ টাকায় ৩০ পয়সায় বিক্রি হয়। এরপর থেকে কার্ব মাকেটে ডলার ৯৬ টাকা থেকে ৯৮ টাকার মধ্যেই কেনাবেচা হচ্ছে।
ওই কয় দিন ইস্টার্ন ও প্রাইম ব্যাংক ৯৮ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। ব্যাংকগুলোর দাবির পরিপেক্ষিতে রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তব্যাংক কেনাবেচার ক্ষেত্রে ডলারের দাম ৮৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। পাশাপাশি আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। ব্যাংকগুলো অবশ্য আন্তব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৯ টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিল।
ব্যাংকগুলো সোম ও মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া ৮৯ টাকা দরে নিজেদের মধ্যে ডলার কেনোবেচা করেছে। আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রেও ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করা দর মেনেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বাজারে ডলারের চাহিদা মেটাতে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের মঙ্গলবার পর্যন্ত অর্থাৎ অর্থবছরের ১১ মাসে মোট ৫৯৫ কোটি (৫.৯৫ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক । বিভিন্ন সময়ে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার দরে এই ডলার বাজারে ছাড়া হয়েছে।
মঙ্গলবার যে ১২ কোটি ৩০ লাখ ডলার ছাড়া হয়েছে তা সোমবার থেকে নতুন বেঁধে দেওয়া দর ৮৯ টাকা দরে বিক্রি করা হয়েছে।
করোনা মহামারির কারণে গত ২০২০-২১ অর্থবছর জুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে গত অর্থবছরে বাজার থেকে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তারই ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।
আগস্ট মাস থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে আমদানি। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। এরপর থেকেই বাড়তে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার দর।
হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এই ১০ মাসে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ।
রিজার্ভে টান
আমদানি বাড়ায় রিজার্ভেও টান পড়েছে। মঙ্গলবার দিন শেষে রিজার্ভ ছিল ৪২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। কয়েকদিন আগেও এই রিজার্ভ ৪২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। বাজারে ডলার ছাড়ায় তা কমে এসেছে।
প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসেবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
অথচ গত বছরের আগস্টে এই রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল, যা ছিল অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ওই সময়ে প্রতি মাসে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসেবে ১০ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুত থাকতে হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৪০
আপনার মতামত জানানঃ