শুষ্ক মৌসুমে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা—রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে সুপেয় পানির সংকট নতুন নয়। এবার সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দূষণ। রাঙামাটির কিছু স্থানে ঝিরিসহ বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা পানিতে ইকোলাই ও কলিফর্মের মতো ব্যাকটেরিয়ার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি পাওয়া গেছে পরীক্ষায়।
এতে জেলায় পানিবাহিত রোগ বাড়ার আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকেরা। অন্যদিকে বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির পানি পরীক্ষা করা না হলেও এই দুই জেলার ডায়রিয়া পরিস্থিতি রাঙামাটির চেয়ে খারাপ।
পানির তীব্র সঙ্কট পাহাড়ে
রাঙামাটির সাপছড়ি ইউনিয়নের মরংছড়ি ও দেপ্পোছড়ি এলাকার অন্তত ৬০ পরিবার চরম পানিসংকটে রয়েছে। সরেজমিনে দেপ্পাছড়িতে দেখা যায়, সকালের দিকে নারীরা পানির জন্য একটি পাতকুয়ায় যান। সেখান থেকে পানি আনতে সময় লাগে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। আশপাশে কোনো অগভীর নলকূপ নেই। কুয়াটিও অরক্ষিত। ঢাকনা নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে রাঙামাটিতে ৫ হাজার ১৭৮ জনের ডায়রিয়া হয়। এর মধ্যে শুধু এপ্রিলে চার হাজারের বেশি। বান্দরবানে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয় ৮ হাজার ৯৯১ জন। শুধু এপ্রিলেই ৭ হাজার ২৪০ জন রোগী পাওয়া যায়, যা সারা দেশে সর্বোচ্চ। এ সময় মারা গেছে একজন।
খাগড়াছড়িতে আক্রান্ত হয়েছে তিন জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৩০৩ জন। তবে এ জেলায় প্রথম তিন মাসে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল বেশি।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাঙামাটির জুরাছড়িতে রাঙাবি চাকমা (৮) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়। একই দিন বান্দরবানের আলীকদমেও এক শিশু মারা যায়।
খাগড়াছড়িতে স্কুলশিক্ষার্থীরাও পানির কষ্টে রয়েছে। পানছড়ি উপজেলার উল্টাছড়ি ইউনিয়নের রোহিন্দ্রপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আশপাশের গ্রামে কোনো পানির উৎস নেই। স্কুল থেকে দূরে আরেকটি পাহাড় ডিঙিয়ে বিদ্যালয়ের ৬৩ শিক্ষার্থীকে পানি পান করতে যেতে হয় বলে জানান প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম।
যেভাবে দূষিত হচ্ছে পানি
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ ও পাহাড়ি পাড়াপ্রধানদের সঙ্গে কথা জানা গেছে, মূলত ডিসেম্বর থেকে মে—ছয় মাস তিন পার্বত্য জেলায় পানির কষ্ট লেগেই থাকে। এ সময়ই দূষণের কারণে বাড়ে পানিবাহিত রোগও। বিশেষ করে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয় বেশি।
পাহাড়ি উৎসের পানি দূষিত হচ্ছে নানাভাবে। প্রাকৃতিক উৎসগুলোর পানি যে পথে আসছে, ওই পথগুলোয় মানুষের বিচরণ বেড়েছে। পানি চলাচলের পথে মিশছে মানুষ ও প্রাণীর মলমূত্র।
কৃষিকাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও ওষুধও মিশছে ঝিরি-ঝরনায়। আবার অগভীর নলকূপের পানিও ভূগর্ভস্থ কারণে দূষিত হতে পারে। গাছপালা ধ্বংস করা এবং বসতি বৃদ্ধিও পানি দূষিত হওয়ার আরেকটি কারণ।
মূলত পাথুরে পাহাড়, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়া ও সরকারিভাবে পর্যাপ্ত নলকূপ না থাকায় সংকট দিন দিন বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) হিসাবে, রাঙামাটি জেলায় ৬৩ শতাংশ, বান্দরবানে ৬১ শতাংশ এবং খাগড়াছড়িতে ৭৮ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। বাকিরা নির্ভর করে প্রাকৃতিক উৎসের ওপর।
তবে পাহাড়ি বিভিন্ন সংগঠনের দাবি, কাগজে–কলমে যত শতাংশ মানুষ পানি সরবরাহের আওতায় আছে বলে দাবি করা হচ্ছে, বাস্তব চিত্র ভিন্ন। তিন জেলায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষ পানি সরবরাহের আওতায় এসেছে।
সমাধানে উদ্যোগ কম
প্রতিবছর পাহাড়ের পানিসংকট হলেও তা সমাধানে সরকারি সংস্থা কার্যকর উদ্যোগ কম বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পানিসংকটের কারণে পাহাড়ের লোকজনের কিডনি, মূত্রনালির সংক্রমণ, চর্মরোগ এবং ডায়রিয়ার মতো রোগ হচ্ছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটি চট্টগ্রামের সদস্যসচিব ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুশান্ত বড়ুয়া বলেন, পানির সাশ্রয় করতে গিয়ে পাহাড়িরা ঠিকমতো পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দিতে পারে না। এতে চর্মসহ নানা রোগে ভুগতে হয়।
পাশাপাশি পানি সংগ্রহের জন্য নষ্ট হয় নিজেদের কর্মঘণ্টা। তিনি আরও বলেন, পরিকল্পনা করে যদি একেক এলাকায় একেক ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে পানিসংকটের সমাধান সম্ভব।
যেমন গভীর নলকূপ, বৃষ্টির পানি ধরে রাখা, বড় কুয়া তৈরি কিংবা পাম্প দিয়ে পানি দেওয়াসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এতে সংকটের সমাধান ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কমে আসবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ