নানা কারণে বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে খাদ্য সঙ্কট, রকেট গতিতে বাড়ছে দাম। এদিকে অভ্যন্তরীণ বাজার ঠিক রাখার অজুহাতে নানা দেশ নিজেদের পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, যা চলমান খাদ্য সঙ্কট পরিস্থিতিকে আরও গভীর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
স্থানীয় বাজারে দাম কমানোর কথা বলে কিছুদিন আগে গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে ভারত। এর দু’সপ্তাহ যেতে না যেতেই চিনি রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। বিশ্বের এক নম্বর চিনি উৎপাদনকারী ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ বছর সর্বোচ্চ এক কোটি টন চিনি রপ্তানি করবে এবং রপ্তানির আগে সরকারের কাছে থেকে ব্যবসায়ীদের অনুমতি নিতে হবে। বিবিসির খবর
ভারতের এই সিদ্ধান্তের পরপরই আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বেড়ে যায় প্রায় এক শতাংশ। এমনিতেই গত জানুয়ারি থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বেড়েছে ১৩ শতাংশ এবং গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বর্তমানে দাম ২৬ শতাংশ বেশি।
এর দুদিন আগে মালয়েশিয়া জানিয়েছে, আগামী জুন মাস থেকে তারা মুরগি ও মুরগির মাংস রপ্তানি কমিয়ে দেবে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ বাজারে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এর আগে পাম অয়েল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল ইন্দোনেশিয়া। প্রায় তিন সপ্তাহ পর গত ২৩ মে এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে তারা।
ভয়াবহ খাদ্য সংকটের শঙ্কায় মিসর। কৃষ্ণসাগর দিয়ে আমদানি-রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়ছে উদ্বেগ। তাই বিপর্যয় এড়াতে কৃষকের কাছ থেকে গম কিনে তা মজুদ করছে দেশটির সরকার। চলতি বছরে অন্তত ৬০ লাখ টন গম মজুদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কায়রো।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কৃষ্ণসাগর দিয়ে মিসরে বন্ধ হয়ে গেছে পণ্য সরবরাহ। তাই দেখা দিতে পারে আমদানিনির্ভর খাদ্যের ভয়াবহ সংকট। এ কারণেই আগাম খাদ্য শস্য মজুদ করে রাখছে দেশটি। বিশেষ করে গমের মজুদ বাড়াচ্ছে কায়রো।
ইন্দোনেশিয়ার পাম অয়েল, মালয়েশিয়ার মুরগি আর ভারতের গম রপ্তানি নিষিদ্ধকরণ— এগুলো বিশ্বে চলমান খাদ্য সংকটের দু-চারটি নমুনা মাত্র। খাদ্য বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি আরও উদ্বেজনক।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে, বাজারে যেভাবে খাদ্যের দাম বাড়ছে তাতে সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতার কবলে পড়বে।
বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ গম রপ্তানিকারক ইউক্রেন। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের কারণে সেদেশ থেকে গম রপ্তানি প্রায় বন্ধ। তাতে বিশ্ববাজারে গমের বাজারের দাম বেড়েই চলেছে এবং মিসরের মত যেসব দেশ খাদ্যের জন্য ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীল, তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
অবস্থা যখন এতটাই সঙ্কটময় তখন নানা দেশ অভ্যন্তরীণ বাজার ঠিক রাখতে যেভাবে খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে তা ‘খুবই উদ্বেগজনক’ বলে উল্লেখ করেন কৃষি বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ। যেটিকে বলা হচ্ছে ‘খাদ্য জাতীয়তাবাদ’।
সম্প্রতি ইউক্রেনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইউরিয়া স্ভিরিদেংকো বলেছেন, তার দেশে লাখ লাখ টন শস্য গুদামে পড়ে রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত একটি ‘সেফ প্যাসেজ’ তৈরি করে সেগুলো রপ্তানির ব্যবস্থা করা।
রাশিয়া বলছে, তারাই ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানি নিশ্চিত করবে, যদি তাদের ওপর চাপানো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞগুলো প্রত্যাহার করা হয়। তবে ইউরোপ-আমেরিকার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আশানুরূপ কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে বিশ্ববাজারে ইউক্রেনের গম ও তেলবীজ প্রবেশ এখনো অনিশ্চিত।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে প্রায় দুই বছর বিশ্ব অর্থনীতি বলতে গেলে অচল হয়েছিল। টিকা আবিষ্কারের পর মহামারির ভয় কাটিয়ে বিশ্ব যখন সবে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করেছিল, ঠিক তখনই ইউক্রেইনে আক্রমণ করে বসে রাশিয়া।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া এই দুই দেশই বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের অন্যতম বড় যোগানদাতা দেশ।
এখন যুদ্ধের কারণে ইউক্রেইন থেকে সব ধরনের পণ্য রপ্তানি বন্ধ আছে। অন্যদিকে, ইউক্রেইনে আগ্রাসনের জেরে পশ্চিমা বিশ্ব কঠোর থেকে কঠোরতর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাশিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে চাইছে। ফলে রাশিয়ার খাদ্যপণ্য রপ্তানিও প্রায় বন্ধ হওয়ার যোগাড়।
এর প্রভাব পড়েছে পুরো বিশ্বজুড়ে। ভোজ্যতেল নিয়ে কাড়াকাড়ির মাধ্যমে যে সঙ্কটের নগ্ন চেহারা বিশ্ববাসীর সামনে এসেছিল তা এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের বেলাতেই প্রকট হয়েছে।
ইউক্রেইনে যুদ্ধের জেরে বিশ্ব জুড়ে যে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তা অতীতের কয়েক দশকের মধ্যে দেখা যায়নি।
অবস্থা যখন এতটাই সঙ্কটময় তখন নানা দেশ অভ্যন্তরীণ বাজার ঠিক রাখতে যেভাবে খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে তা ‘খুবই উদ্বেগজনক’ বলে উল্লেখ করেন কৃষি বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ। যেটিকে বলা হচ্ছে ‘খাদ্য জাতীয়তাবাদ’।
ইউক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি অস্বাভাবিক খরা ও বন্যায় অনেক দেশেই ফসল উৎপাদন হুমকিতে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা আশা করছিলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে শস্যবাজারে যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, ভারত থেকে বাড়তি গম আমদানি করে তার কিছু অংশ পূরণ করা যাবে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও প্রথমদিকে এমন আশার বাণী শোনানো হয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত নিজেদের সিদ্ধান্ত বদল করে তারা।
এভাবে বিভিন্ন দেশের সরকার যেভাবে খাদ্যপণ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করছে তাকে ‘খাদ্য জাতীয়তাবাদ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ স্কুল অব পাবলিক পলিসির সহকারী অধ্যাপক সোনিয়া আক্তার। তিনি বলেন, সরকার এসব বিধিনিষেধ আরোপের কারণ, তারা মনে করছে, প্রথমে নিজের জনগণকে রক্ষা করতে হবে।
অধ্যাপক সোনিয়া বলেন, ২০০৭-২০০৮ সালের খাদ্য সংকটের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এসব দেশ আবারও এ ধরনের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার পথে যাবে। এর ফলে খাদ্য সংকট বাড়বে এবং বাজারে খাবারের দামও বাড়তে থাকবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫২
আপনার মতামত জানানঃ