পশ্চিম তীরের জেনিনে ১১ মে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন আল–জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ। ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ৫১ বছর বয়সী এ সাংবাদিক ঘটনার দিন সুরক্ষিত পোশাক পরে ছিলেন। তাঁর পোশাকে প্রেস লেখা ছিল। অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে ছিলেন শিরিন। হঠাৎ একটি গুলি এসে তার গায়ে লাগে, মারা যান শিরিন। সেই ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ।
বৃহস্পতিবার(২৬ মে) ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত রিপোর্টে জানায়, আল জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহকে ইসরায়েলি বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করেছে। এভাবে হত্যা করা আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধের সামিল।
স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার পশ্চিম তীরের রামাল্লায় ফিলিস্তিনের অ্যাটর্নি জেনারেল আকরাম আল-খতিব এই তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন। তিনি বলেন, এটি স্পষ্ট যে ইসরায়েলি বাহিনীর একজনের গুলি সরাসরি সাংবাদিক শিরিনের মাথায় আঘাত করে। এতে মারা যান তিনি। দায়িত্ব পালনের সময় তিনি হেলমেট ও প্রেস লেখা সম্বলিত জ্যাকেট পরিহিত ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন, প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ ও একটি ফরেনসিক রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই এই তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এর আগে ইসরায়েলি বাহিনী দাবি করে ফিলিস্তিনিদের গুলিতেই নিহত হন শিরিন। আল-খতিব আরও বলেন যে তদন্তে দেখা গেছে গুলি করার সময় ঘটনাস্থলের কাছাকাছি কোনও ফিলিস্তিনি যোদ্ধা ছিলেন না। ইসরায়েলি বাহিনী আবু আকলেহ এবং অন্যান্য সাংবাদিকদের স্পষ্টভাবে প্রেসের সদস্য হিসাবে চিহ্নিত করার পরও গুলি চালায় বলে জানান তিনি।
ইসরায়েলের দখলকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে গত ১১ মে অভিযান চালায় দেশটির সেনারা। সংবাদ সংগ্রহের জন্য সেখানে ছিলেন ৫১ বছর বয়সী শিরিন আবু আকলেহ। প্রত্যক্ষদর্শী ও তার সহকর্মীদের অভিযোগ, ইসরায়েলের এক সেনা মাথায় গুলি করলে শিরিন আবু আকলেহ প্রাণ হারান।
হামলার সময় সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার আরেক সাংবাদিক আলী আল-সামুদির পিঠে গুলি লাগে। তার অবস্থা এখনো স্থিতিশীল রয়েছে বলেও জানান।
এ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর ইসরায়েলের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। ইসরায়েলের সামরিক প্রসিকিউটর সেনাবাহিনীকে ঘটনার তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু গত সপ্তাহে, ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, সাংবাদিক শিরিন হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করবে না ইসরায়েল।
ইসরায়েলি বাহিনী আবু আকলেহ এবং অন্যান্য সাংবাদিকদের স্পষ্টভাবে প্রেসের সদস্য হিসাবে চিহ্নিত করার পরও গুলি চালায়।
সাংবাদিক শিরিনের হত্যাকাণ্ড গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এমনকি তার কফিন বহন করা ফিলিস্তিনিদের ওপরেই হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ বিশ্ববাসী। ইসরায়েলের এমন হিংস্র আচরণের কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় বিভিন্ন দেশের প্রধানরা। দ্রুত ঘটনার তদন্ত করে বিচারের দাবি জানান তারা।
সিএনএন ও এপিসহ অনেক মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে, সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতেই নিহত হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েলি বাহিনী এই রিপোর্টকে প্রত্যাখ্যান করে জানায়, শিরিনকে ফিলিস্তিনিরাই হত্যা করেছে।
ফিলিস্তিনের তথ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, ২০০০ সাল থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে কমপক্ষে ৪৫ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। তবে ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নের তথ্যানুসারে, মৃতের সংখ্যা আরও বেশি। তারা বলছে, ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ৫৫ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট ১৯৯২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েল ও অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভুখন্ডে ১৭ জন সাংবাদিক নিহত হওয়ার নিশ্চিত ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এর মধ্যে ১৫ জন সাংবাদিক সরাসরি ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে নিহত হন।
২০১৯ সালে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল কমিশনের রিপোর্ট বলছে, সাংবাদিকদের পরিকল্পিতভাবে গুলি করে ইসরায়েলি স্নাইপাররা। কারণ এ সব সাংবাদিকদের শরীরে থাকা জ্যাকেটে পরিষ্কার করে প্রেস শব্দ লেখা ছিল। তবে এই প্রতিবেদনকে পক্ষপাতদুষ্ট ও বিকৃত দাবি করে নাকচ করে দিয়েছে ইসরায়েল।
রিপোর্টার্স উইথাউট বর্ডার্স বলছে, শুধু টার্গেট কিলিংই নয়, ২০১৮ সালের গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন প্রটেস্টসের পর থেকে ইসরায়েলি রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস ও গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন ১৪৪ সাংবাদিক। গেল বছর পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জাররাহতে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি ও আরব-ইসরায়েলিদের ঘর দখল ইস্যুতে প্রতিবাদের খবর সংগ্রহের সময় আল-জাজিরার সাংবাদিক গিভারা বুদেরিকে টেনে-হিচড়ে পুলিশ ভ্যানে তুলে নেয় ইসরায়েলি বাহিনী। বিশ্বজুড়ে সমালোচনার পর তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় দেশটি।
অনেক দেশেই দুর্নীতি, পাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনুসন্ধানে গিয়ে সাংবাদিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। এছাড়া, অপহরণ, নির্যাতন, ডিজিটাল ও অন্যান্য মাধ্যমে গুজব রটানোসহ নানা হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে সাংবাদিকদের। নারী সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে অনলাইন সহিংসতার মাত্রা বেশি বলেও জানিয়েছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, সাংবাদিকরা আরও অগুনিত হুমকির মুখোমুখি হচ্ছেন। যেমন—অপহরণ, নির্যাতন ও গুম থেকে শুরু করে গুজব রটানো ও হয়রানি, বিশেষত ডিজিটাল মাধ্যমে, অনেক ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিশেষত নারী সাংবাদিকরা সহিংসতার ঝুঁকিতে বেশি।
তিনি বলেন, সমাজের ওপর সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অপরাধের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। কারণ তারা তথ্যপ্রাপ্তির মাধ্যমে মানুষকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সহযোগিতা করেন। কোভিড-১৯ মহামারি এবং ভুল তথ্যের ছায়া মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে যে সঠিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য সত্যিকার অর্থেই জীবন-মৃত্যুর পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। তথ্যপ্রাপ্তি যখন হুমকিতে পড়ে, তখন তা এমন বার্তা পাঠায়, যা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনও রাষ্ট্র যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করে, তবে সেখানে গণমাধ্যমের একশভাগ স্বাধীনতা থাকতেই হবে। যে গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করবে, সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আবার সেই সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। জনসাধারণের কথাই উঠে আসে গণমাধ্যমে। তাই এই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত না করতে পারলে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৬
আপনার মতামত জানানঃ