ভারতের উত্তর প্রদেশে পূজা করার অধিকারের দাবির পর এবার পুরো জ্ঞানবাপী মসজিদ চত্বরেই মুসলমানদের প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির দাবি করা হয়েছে হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষ থেকে। মঙ্গলবার এই দাবিতে বারানসি আদালতে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। আদালত আবেদনটি শুনানির জন্য গ্রহণও করেছে।
প্রসঙ্গত, জ্ঞানবাপী নিয়ে আরেকটি মামলা হলো বারাণসীর আদালতে। হিন্দুত্ববাদীদের করা মামলায় বলা হয়েছে, মসজিদ চত্বরে মুসলিমদের প্রবেশ বন্ধ হোক। আবেদনে বলা হয়েছে, পুরো জমিটাই কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের। সেখানে তাই মসজিদ থাকতে পারে না। পুরো জমি মন্দির কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়া হোক।
জ্ঞানবাপী নিয়ে মুসলিম পক্ষের আইনজীবী অভয় যাদব ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ”জ্ঞানবাপী মসজিদের জমি ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি।”
গত ১৭ মে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল যে, জ্ঞানবাপী মসজিদে নামাজ পড়া যাবে। বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ জেলাশাসককেও নির্দেশ দিয়েছে, মুসলিমরা যাতে নামাজ পড়তে পারেন, তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে।
পাশাপাশি ওজুখানা ও তহখানা সিল করে দেয়ায় ওজুর জন্য জলের ব্যবস্থা করার জন্যও জেলাশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতিরা।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জ্ঞানবাপী সংক্রান্ত আগেকার আবেদনের বিচার এখন জেলা বিচারকের আদালতে হচ্ছে। মঙ্গলবার সেখানে শুনানি হয়েছে। ২৬ মে আবার হবে। তারপর রায় দিতে পারেন বিচারক। তার মধ্যেই আরেকটি আবেদন জানানো হলো।
এই পরিস্থিতিতে বারানসির আদালতের পক্ষে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার বন্ধের আবেদনের শুনানি করা আইনগত ভাবে এক্তিয়ারভুক্ত কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে, বেঙ্গালুরুর বেসরকারি নিউ হরাইজন স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রাক্তন পড়ুয়াদের নির্দেশ দিয়েছে, তারা যেন গুগল ম্যাপে জ্ঞানবাপীকে মসজিদ না বলে মন্দির বলে উল্লেখ করে। যতক্ষণ পর্যন্ত গুগল মসজিদ বদলে মন্দির না লিখছে, ততদিন পর্যন্ত এই কাজ করে যেতে হবে বলে তারা নির্দেশ দিয়েছে।
কীভাবে গুগল ম্যাপে পরিবর্তন করতে হবে, তাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সাবেক পড়ুয়াদের ইমেল করে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, স্ক্রিনিং না করেই ইমেল পাঠানো হয়েছিল। এর আগে এই স্কুল সমস্ত ছাত্রদের ‘কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটি দেখতে বাধ্য করেছিল।
উল্লেখ্য, ভারতীয় হিন্দুদের প্রধান তিনটি উপাসনাস্থল বিতর্কিত। অযোধ্যায় রামের জন্মভূমি, কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির ও মথুরার শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি। বিতর্কের কারণ, তিন উপাসনাস্থলে তিনটি মসজিদের অবস্থান। কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের দাবি, তিনটি উপাসনাস্থলের চরিত্র বদল করে প্রাচীনকালে মুসলমান শাসকেরা সেখানে মসজিদ তৈরি করেছিলেন। অযোধ্যায় রামের জন্মস্থলে বাবরি মসজিদ, কাশীতে বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙে জ্ঞানবাপী মসজিদ এবং মথুরায় শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থানে শাহি ঈদগাহ মসজিদ।
আশির দশকের শেষে বিজেপির সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সংগঠন অযোধ্যার ‘মুক্তি আন্দোলন’ শুরুর সময় থেকেই বলে এসেছে, এই তিন উপাসনাস্থলকে ‘মসজিদমুক্ত’ করা তাদের মূল লক্ষ্য। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে তাই স্লোগান উঠেছিল, ‘আভি সির্ফ অযোধ্যা হ্যায়, কাশী–মথুরা বাকি হ্যায়।’ অর্থাৎ এখন অযোধ্যা মুক্ত হচ্ছে। পরে মুক্ত হবে কাশী ও মথুরা। জ্ঞানবাপী মসজিদের জরিপ সেই প্রচেষ্টারই একটা ধাপ।
এই জরিপের নির্দেশ, যা বারানসির দেওয়ানি আদালতের দেওয়া, তা পরিষ্কারভাবে ১৯৯১ সালের কেন্দ্রীয় উপাসনালয় আইনের পরিপন্থী বলে মসজিদ কমিটির আইনজীবী হুজেফা আহমদি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। জরিপ রুখতে ১৩ মে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণের এজলাসে আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, অবিলম্বে জরিপ রোখা উচিত। কারণ, তা ১৯৯১ সালের উপাসনালয় আইন লঙ্ঘন করছে।
উপাসনালয় আইনটি এনেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও, অযোধ্যা অন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। ১৯৯১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আনা এই আইনের নির্যাস, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট, ভারতের স্বাধীন হওয়ার দিন দেশের সব উপাসনালয়ের চরিত্র যেমন ছিল, তেমনই থাকবে। কোনো রকম পরিবর্তন করা যাবে না। অর্থাৎ মন্দির ভেঙে মসজিদ অথবা মসজিদ ভেঙে মন্দির, উপাসনালয়ের চরিত্র ওই দিন যেমন ছিল, তেমনই থাকবে। একমাত্র ব্যতিক্রম অযোধ্যা।
জ্ঞানবাপী মসজিদ কমিটির দাবি, বারানসি আদালতের নির্দেশ ওই কেন্দ্রীয় আইন ভঙ্গ করছে। প্রধান বিচারপতি ওই আরজি গ্রহণ করলেও মামলার গতিবিধি জানা না থাকায় জরিপের নির্দেশের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দিতে চাননি। কিন্তু মামলাটি শুনানির জন্য পাঠান বিচারপতি চন্দ্রচূড় ও বিচারপতি নরসিংহের এজলাসে। আগামীকাল সেই শুনানি। যদিও তার আগে মসজিদ জরিপের কাজ শেষ।
বারানসির দেওয়ানি আদালতে পাঁচ হিন্দু নারী আবেদন জানিয়েছিলেন, জ্ঞানবাপী মসজিদের পশ্চিমের দেয়ালের বাইরের দিকে যে হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তি রয়েছে, সেখানে বছরভর পূজা করার অধিকার দেওয়া হোক। পূজার সেই অধিকার এখন রয়েছে বছরে মাত্র এক দিন—চৈত্র মাসে নবরাত্রি চলাকালীন। বছরভর অধিকার দেওয়া যায় কি না, তা বিবেচনার জন্যই মসজিদ চত্বরে ভিডিও জরিপের নির্দেশ দেওয়া হয়। তারও আগে এই একই দাবিতে আদালতে গিয়েছিল এক কট্টরপন্থী হিন্দু সংগঠন ‘স্বয়ম্ভু জ্যোতির্লিঙ্গ ভগবান বিশ্বেশ্বর’।
তাদের আরজি, ১৬৬৪ সালে মোগল সম্রাট আরঙ্গজেব কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের একাংশ ধ্বংস করে এই মসজিদ তৈরি করেছিলেন। মসজিদের পশ্চিম প্রান্তের দেয়ালে তার প্রমাণ রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষাতেও তা প্রমাণিত হবে। সে ক্ষেত্রে ওই মসজিদ হিন্দুদের হাতে তুলে দেওয়া হোক। মসজিদ কমিটির আপত্তি এই সব দাবি ঘিরে। জরিপের বিরুদ্ধে আবেদনও জানানো হয় এলাহাবাদ হাইকোর্টে। হাইকোর্ট আবেদন খারিজ করে দিলে মসজিদ কমিটি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৩৫
আপনার মতামত জানানঃ