সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় ক্ষমতাসীন দল বা তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীর নামই বেশি আসে খবরে৷ তবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অন্য ‘বড় দলগুলোর’, এমনকি তথাকথিত অরাজনৈতিক সংগঠন বা বিভিন্ন পেশাজীবীদের রোষানলেও পড়তে হয় সাংবাদিকদের৷
সম্প্রতি সাতক্ষীরার সদর উপজেলায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করার সময় স্থানীয় এক সাংবাদিককে বেধড়ক পেটানো হয়েছে। রোববার (২২ মে) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
মারধরে আহত সাংবাদিক ইয়ারব হোসেন মানবজমিন পত্রিকার সাতক্ষীরা প্রতিনিধি। চলমান বেতনা নদী খননকাজ প্রকল্পের তথ্য নেওয়ার জন্য গেলে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়েরের নেতৃত্বে সিকিউরিটি গার্ডরা তার ওপর এ হামলা চালায়।
এ ঘটনার সময় উপস্থিত থাকা প্রত্যক্ষদর্শী মাছুম নামের একজন বলেন, আমি দেখলাম সাংবাদিক ইয়ারব হোসেন গাড়ি থেকে নেমে পানি উন্নয়ন বোর্ড-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়েরের রুমের সামনে যান। তারপর সেখানে দাঁড়ান। কিছুক্ষণ পর আবুল খায়ের বেরিয়ে সিকিউরিটি গার্ডদের কিছু একটা ইশারা করেন। পরে সিকিউরিটি গার্ডরা এসে কোনো কারণ ছাড়াই লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারতে শুরু করেন তাকে।
এ বিষয়ে সাংবাদিক ইয়ারব হোসেন বলেন, বেতনা নদী খননকাজ চলমান প্রকল্প। আমি এ প্রকল্প বিষয়ে কিছু তথ্য নেওয়ার জন্য অফিসে আসি। প্রকৌশলী আবুল খায়েরের রুমের সামনে আসার দুই-তিন মিনেটের মধ্যেই তিনি রুম থেকে বেরিয়ে আসেন। লক্ষ করলাম সিকিউরিটিদের লাঠি নিয়ে আসার ইশারা দেন তিনি। মুহূর্তের মধ্যেই লাঠি নিয়ে আমার ওপর হামলে পড়ে সিকিউরিটি গার্ডরা।
তিনি আরও বলেন, পরে আবুল খায়েরের নির্দেশে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী জাকির হোসেন, উপসহকারী কর্মকর্তা তন্ময় কুমার, সিকিউরিটি গার্ড প্রধান শহিদুল ইসলামসহ অফিসের ১০ থেকে ১৫ জন এ হামলায় যোগ দেয়। তারা আমাকে লাঠি দিয়ে আঘাত, চড়, কিল, ঘুষি মারতে থাকে। এ সময় আমার মোবাইল ফোনটিও কেড়ে নেয় তারা।
ঘটনাটি জানাজানি হলে জেলার কর্মরত সাংবাদিকরা ছুটে যান পাউবো কার্যালয়ে।
দুপুর ১২টার দিকে পাউবো কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন শতাধিক সাংবাদিক। প্রকৌশলী খায়েরসহ জড়িতদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন তারা।
প্রকৌশলী খায়েরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে সাত দিনের মধ্যে তার অপসারণসহ জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন সাংবাদিকরা।
তবে নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের মারপিটের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘সাংবাদিক ইয়ারব আমার সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। মারপিটের বিষয়টি হাস্যকর। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।’
এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হুমকি ও অশোভন আচরণের জন্য থানায় জিডি করায় সময় টিভির সাংবাদিকসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে চাঁদাবাজির মামলা করেছেন জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক আনারকলি।
রোববার (২২ মে) সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্টেট (আশুগঞ্জ) আদালতে মামলাটি করেন তিনি। সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আছমা আক্তার নিপা এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য আশুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার আসামিরা হলেন- স্থানীয় সাংবাদিক ও চর চারতলার বাসিন্দা সাদেকুল ইসলাম সাচ্চু (৪০), একই গ্রামের নুরুল্লাহ (৩৫), মাহবুব, সালমান (২৫), হাছান জাবেদ (৩০) এবং সময় টিভি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যুরো প্রধান উজ্জল চক্রবর্তী (৪২)।
এদিকে মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আনারকলির হুমকিতে শুধু ওই সাংবাদিকই নয়, আশুগঞ্জ উপজেলার এসিল্যান্ডও থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে বাধ্য হয়েছেন।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আনারকলি বাংলাদেশ রেলওয়ে ভূ-সম্পতি বিভাগ থেকে এক হাজার ১১৮৮ বর্গফুট ভূমি ইজারাপ্রাপ্ত হয়ে গত ১৪ মে ওই ভূমিতে অস্থায়ীভাবে দোকান নির্মাণ কাজ শুরু করলে মামলার আসামিরা ঘটনাস্থলে এসে তার কাছে চাঁদা দাবি করেন। তিনি চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আসামিরা কাজ বন্ধ করতে আশুগঞ্জ এসিল্যান্ডকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঘটনাস্থলে নিয়ে আসেন। এসিল্যান্ড মো. আশরাফুল হক মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রীর বাদানুবাদের এক পর্যায়ে আনারকলিকে চড়থাপ্পড় মারবেন বলে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। তিনি তার সপক্ষের কাগজপত্র নিয়ে আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রদর্শনের পর তিনি পুনরায় কাজ আরম্ভ করেন। মামলার আসামিরা ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতনসহ পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবিতে কাজ বন্ধের হুমকি দেন।
যে-ই সুযোগ পাচ্ছে সে-ই সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন করছে৷ সেটা যে শুধু সরকারি দলের লোক তা নয়, ব্যবসায়ীরা করছে, অর্থশালীরা করছে৷ আসলে সাংবাদিকদের খবরটি যাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, তারাই এটা করছে৷
মামলার এজাহারে তিনি আরও অভিযোগ করেন, মামলার আসামি ও স্থানীয় সাংবাদিক সাদেকুল ইসলাম সাচ্চু, হাছান জাবেদ সময় টিভির ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যুরো প্রধান উজ্জল চক্রবর্তীকে সঙ্গে নিয়ে গত ১৯ মে তার নির্মাণাধীন মার্কেটে গিয়ে হুমকি দেন চাঁদা না দিলে কাজ বন্ধ থাকবে। আনারকলি চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে আসামিদের মধ্যে ক’জন সাংবাদিক তাকে শারীরিকভাকে নির্যাতন করেন। তিনি অভিযোগ করেন আসামিরা তার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপত্তিকর, কুরুচিপূর্ণ এবং মানহানিকর নানা পোস্ট দেন। মামলার আরজিতে সময় টিভির ব্যুরো প্রধান উজ্জল চক্রবর্তীকে কথিত সাংবাদিক হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সময় টিভির ব্যুরো প্রধান উজ্জল চক্রবর্তী বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আশুগঞ্জে রেলওয়ের জায়গা অবৈধভাবে ভরাটের কথা জানতে পেরে গত ১৮ মে দুপুরে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আমাকে হুমকি দেন। ‘আপনারা ভুয়া সাংবাদিক, এখানে আমার কাছ থেকে টাকা নিতে এসেছেন’ বলে আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। এ ঘটনায় আমি ওইদিনই আনারকলির বিরুদ্ধে আশুগঞ্জ থানায় সাধারণ ডায়েরি করি।
এ ব্যাপারে আশুগঞ্জ উপজেলা এসিল্যান্ড মো. আশরাফুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, রেলের জায়গার পাশের খাস জমিও তিনি ভরাট করছেন দেখে তাকে বাধা দিই। এ সময় তিনি আমার সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন এবং উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের নামে হুমকি দেন। এ ঘটনার পর আমার পক্ষে অফিসের নাজির মনিরুজ্জামান খন্দকার আশুগঞ্জ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
এ ব্যাপারে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক আনারকলির সঙ্গে যোগাযোগ করলে মামলার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, সময় টিভির ব্যুরো প্রধান উজ্জল চক্রবর্তী তার কাছে কোনো চাঁদা চাননি।
তিনি দাবি করেন, গত ১৯ মে সময় টিভিতে তাকে নিয়ে সম্প্রচারিত সংবাদে তার মানহানি হয়েছে।
মানহানির মামলা না দিয়ে কেন চাঁদাবাজির মামলা দিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কতজন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার কোনো হিসেব নেই৷ বিভিন্ন মেয়াদের বিচ্ছিন্ন কিছু হিসাব পাওয়া যায়৷ ২০০১ সাল থেকে ২০১৬- এই ১৬ বছরে দেশে ২৩ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন৷ বিএনপির ২০০১-২০০৬ শাসনামলে নিহত হন ১৪ জন সাংবাদিক, আর আহত হন ৫৬১ জন৷ আর ২০০৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে নয় বছরে খুন হন নয় জন সাংবাদিক৷
আরেক পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে বাংলাদেশে ৩৮ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন৷ নির্যাতন বা হত্যাকাণ্ডের এই খতিয়ান পূর্ণাঙ্গ নয়৷ অনেক ঘটনাই রয়ে গেছে আড়ালে৷
বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতন যেন নিত্যদিনের ঘটনা৷ শুধু হামলা নয়, প্রচুর মামলারও শিকার হন সাংবাদিকরা৷ ২০২১ সালে শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কমপক্ষে ১ হাজার ১৩৪টি মামলা হয়েছে৷ এই মামলাগুলোর বড় একটা অংশ হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে৷
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, করোনাকালে এবং এর আগে-পরে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সরকারি কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন দল ও বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের রোষানলে পড়ে হামলা, মামলাসহ নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ২১০ জন সাংবাদিক৷ এর মধ্যে নোয়াখালিতে বোরহান উদ্দিন মোজাক্কির নামে একজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে-ই সুযোগ পাচ্ছে সে-ই সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন করছে৷ সেটা যে শুধু সরকারি দলের লোক তা নয়, ব্যবসায়ীরা করছে, অর্থশালীরা করছে৷ আসলে সাংবাদিকদের খবরটি যাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, তারাই এটা করছে৷
তারা মনে করেন নির্যাতনকারীদের কঠোর শাস্তি হলে বারবার নির্যাতনের ঘটনা ঘটতো না৷ তারা বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী৷ বিচারের জন্য বছরের পর বছর ঘুরতে হচ্ছে৷ এই যে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ১২ বছরে পুলিশ ৮৮ বার আদালত থেকে সময় নিয়েছে, অথচ খুনিদের ধরতে পারেনি৷ বিচারহীনতার এই সংস্কৃতিটাই সাংবাদিকতা পেশাকে আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে৷
তারা আরও বলেন, যাদের বিরুদ্ধে খবর হচ্ছে, তারাই হামলা করছে৷ যারা অন্যায় করে, দখল করে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে, তারাই হামলাকারী৷ আবার নির্দিষ্ট কোনো পেশার সবাই কিন্তু এটা করেন না৷ এই খারাপ মানুষগুলোই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কথা বলেন৷ আমাদের এখন থেকে শক্তভাবে প্রতিবাদ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৩
আপনার মতামত জানানঃ