বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে চাল, বাদাম ও ভুট্টার ৬০টি নমুনার মধ্যে ৯টিতে লিভার ক্যানসারের জন্য দায়ী বিষাক্ত অ্যাফ্লাটক্সিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বাদাম ও ভুট্টাতেই এর উপস্থিতি বেশি। এদিকে ময়মনসিংহে সালাদ তৈরির সবজি ও দুগ্ধজাত খাবারে মিলেছে লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজেনিস নামক রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া।
এ ছাড়া কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের লইট্টা শুঁটকিতে ক্ষতিকর ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি মিলেছে। আর কিছু অঞ্চলে গরুর দুধে সামান্য পরিমাণে অ্যামোক্সিসিলিন অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি ধরা পড়েছে।
নেদারল্যান্ডস সরকারের অর্থায়নে অরেঞ্জ নলেজ প্রোগ্রামের অধীনে পাঁচটি পৃথক গবেষণায় এসব ফলাফল উঠে এসেছে। ২০২১ সালজুড়ে গবেষণাগুলো পরিচালিত হয়। আজ শনিবার রাজধানীর শাহবাগে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে আয়োজিত একটি কর্মশালায় এসব ফলাফল তুলে ধরা হয়।
নেদারল্যান্ডস সরকারের ‘বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা জোরদারকরণে কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ (টিভিইটি) ও উচ্চশিক্ষা প্রকল্প’ এ কর্মশালার আয়োজক।
খাদ্যশস্যে যকৃত ক্যানসারের জন্য দায়ী অ্যাফ্লাটক্সিন নামক উপাদানের উপস্থিতি নিয়ে করা এই গবেষণা অনুসারে, সংগৃহীত নমুনার ৯টিতে অ্যাফ্লাটক্সিন পাওয়া গেছে। এসবের চারটিতে ছিল নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি উপস্থিতি। মূলত বাদাম ও ভুট্টাতেই এর উপস্থিতি বেশি। আর চালের একটি নমুনায় তা পাওয়া গেছে।
গবেষক তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, অ্যাফ্লাটক্সিন আদর্শসীমার মধ্যে থাকলে তা তেমন ক্ষতিকর নয়। মাত্রাতিরিক্ত হলে তা ক্যানসার, কিডনি রোগের কারণ হতে পারে।
সালাদ তৈরির সবজি ও দুগ্ধজাত খাবারে লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজেনিস নামক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি নিয়ে আরেকটি গবেষণায় নমুনার ১৯ দশমিক ২ শতাংশ শসা, ১০ শতাংশ টমেটো ও ৩ দশমিক ৪ শতাংশ গাজরে এ ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আর দুগ্ধজাত পণ্যের মধ্যে ৭ দশমিক ১ শতাংশ আইসক্রিমে ও ৪ শতাংশ দইয়ে লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজেনিস ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
অধ্যাপক মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এ ব্যাকটেরিয়া মূলত শৌচাগার থেকে মানুষের হাত ও মাটির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, দুগ্ধজাত পণ্যে এ ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। সবজি পরিষ্কার ও সেদ্ধ করে খেলে এ ব্যাকটেরিয়া মরে যায়। কিন্তু দই, আইসক্রিম তো ধুয়ে খাওয়া যায় না। এ ব্যাকটেরিয়া মানুষের জ্বর ও পেটের অসুখ, শরীর ব্যথা, মেয়েদের বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে।
অন্য একটি গবেষণায় ক্ষতিকর ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া খুঁজতে মূলত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের অঞ্চলের কাঁচা লইট্টা, আধা ও পুরোপুরি শুকনো লইট্টা শুঁটকি পরীক্ষা করা হয়। সেখানে শতভাগ লইট্টার নমুনাতেই এই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। গবেষণা অনুসারে ৪৫টি নমুনার ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগ সৃষ্টিকারী এই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। আর ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ নমুনায় অ্যান্টিবায়োটিক সহনশীল ই কোলাই ব্যাকটেরিয়া রয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক গবেষক মো. শাহেদ রেজা বলেন, শুঁটকি ধোয়ার পানিতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি থাকলে, শুঁটকি ভালো করে না শুকানো হলো ও বেশি তাপমাত্রায় রান্না না করলে তা পেটে গেলে শরীরে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হতে পারে। এ ছাড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের স্থান, গুদাম, শুঁটকির বস্তায়ও এ ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়াটি পাওয়া গেছে। কিছু অঞ্চলে ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় লইট্টা সেদ্ধ করা হয় না, তাই সেখানে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি।
এ ছাড়া সিপ্রোফ্লোক্সাসিন ও অ্যামোক্সিসিলিন অ্যান্টিবায়োটিক পরীক্ষার জন্য মানিকগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের স্থানীয় বাজারের খুচরা বিক্রেতা এবং পাবনা ও সিরাজগঞ্জের দুধ সংগ্রহ কেন্দ্র ও খামার থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এ গবেষণার মূল গবেষক বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মনজুর মোরশেদ আহমেদ।
গবেষণা অনুসারে, সংগৃহীত ২০০ নমুনার মধ্যে ৬টিতে অ্যামোক্সিসিলিন অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে। তবে সিপ্রোফ্লোক্সাসিন পাওয়া যায়নি। মূলত গরুর স্তনপ্রদাহের চিকিৎসার জন্য গরুর শরীরে এসব অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হচ্ছে। যেসব কৃষকের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, তাঁদের ৭০ শতাংশই দুধ ও মাংস খাওয়ার মাধ্যমে মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রবেশের বিষয়টি জানেন না। ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ কৃষক নিজেরাই অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করেন।
অন্যদিকে, সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে ভারী ধাতু আর্সেনিক, সিসা, ক্রোমিয়াম ও ক্যাডমিয়ামের পরীক্ষা করা হয়। পশুর নদের সাতটি বিভিন্ন স্থান ও এ নদীসংলগ্ন সাতটি বিভিন্ন খাল এবং ছোট নদী থেকে কাদামাটি ও পানি সংগ্রহ করা হয়েছে। পাশাপাশি ১০ প্রজাতির মাছেও এসব উপাদান পরীক্ষা করা হয়।
গবেষণা অনুসারে, মোংলা বন্দর, বন্দরের কাছাকাছি সিমেন্ট কারখানার পাশে নদীতীর, মোংলা ঘাটের মোহনা ও বাণীশান্তা বাজারে নির্ধারিত মাত্রার বেশি ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। তবে মাছের মধ্যে যে পরিমাণ উপস্থিতি মিলেছে, তা আশঙ্কাজনক নয়।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, কাদামাটিতে এসব ধাতু থাকা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এ পানি খাওয়ার উপযোগী নয়। সুন্দরবন রক্ষায় এখনই এসব ধাতুর বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ