মিজানুর রহমান খান : ১১ বছরের ব্যবধানে একটি ‘বন্দুকযুদ্ধ’শূন্য মাস দেখে কি আমরা আশাবাদী হতে পারি? ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার ফোরামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্সের’ ঘোষণা কি আমাদের আশ্বস্ত করেছিল? আমরা কি লিখিনি যে জানুয়ারি মাসে দেওয়া সরকারি অঙ্গীকারের ফল মার্চেই ফলতে শুরু করল। সুতরাং আমরা আশাবাদী হতে পারি। কিন্তু সেই আশাবাদ কত দিন টিকেছিল?
প্রশ্ন আরও আছে। গত সেপ্টেম্বর মাস যে ‘শূন্য’ গেল, সেটা আমাদের রাষ্ট্র বলেনি। কারণ, এই ‘অগ্রগতি’ রাষ্ট্র গ্রহণ করেনি। ২০০৯ সালের মার্চের সঙ্গে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের যে মিল, সেটা কাকতালীয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবের ভিত্তি সংবাদমাধ্যম। একটি রাষ্ট্র মানুষ ধরে নেবে। তুলে নেবে। তারা পরিবারকে খবর দেবে না। তারা সুপ্রিম কোর্টের গ্রেপ্তার ও রিমান্ড–সংক্রান্ত গাইডলাইন মানতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে বাধ্য করবে না। এমন একটি অবস্থায় বন্দুকযুদ্ধশূন্য সেপ্টেম্বর মাস দেখে আমরা যদি ভাবতে বসি যে এই রাষ্ট্র ভালো হয়ে যাচ্ছে, সেটা যুক্তির কথা নয়।
আমরা প্রশ্ন তুলে যাব। কারণ, নাগরিক হিসেবে সেটাই আমাদের কাজ। আমরা তাই প্রশ্ন তুলছি, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গোটা দেশ বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। সেপ্টেম্বর তাই একটা ‘অস্ত্রবিরতি’ কি না? সিনহা হত্যাকাণ্ডের পরপরই আগস্টে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ‘পুলিশের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, এটাই শেষ ঘটনা। ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।’ এখানেই আশাবাদ, এখানেই প্রশ্ন। তার মানে কী, এটি পুলিশের নীতিগত অবস্থান? আমরা কি ভাবতে বসব যে এই একটি বাহিনী আর কখনোই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ করবে না? তা তিনি দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হোন আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হোন, রাষ্ট্র করতে বললেও পুলিশ করবে না। কে কার পক্ষে এই ‘আশ্বস্ত’ করল, সেটা পরিষ্কার জানাবোঝা গেলে খুবই ভালো হতো। কিন্তু আমরা সেটা জানব না।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের সঙ্গে মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের কিছু মিল বা তুলনীয় কিছু রয়েছে। সেখানে নিহত ব্যক্তিরা সবাই আমজনতার সদস্য ছিলেন। তাঁদের খুনিরা ছিলেন নিরাপত্তা বা আইনরক্ষী বাহিনীর। কক্সবাজারের ঘটনায় সন্দেহভাজন খুনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এবং খুনের শিকার ব্যক্তি সামরিক বাহিনীর সাবেক সদস্য। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন নিয়ে কত হইচই হয়েছিল; কিন্তু গত ৬ আগস্টের ওই বিবৃতির মতো কিছু একটা কি আমরা তখন পেয়েছিলাম? পাইনি। ২০০১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি। এই তথ্যের উৎস কী? যারা মারে তারা কি হিসাব রাখে? যদি তারা না রাখে, তাহলে কেন রাখে না, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এই পরিসংখ্যান সরকারি নয়। কিন্তু কেউ কি আমাদের বলবে যে এই ‘হত্যাকাণ্ড’ বা নিহত মানুষের সংখ্যা পুলিশের ওয়েবসাইটে কেন আলাদাভাবে জায়গা পায় না। প্রকৃত ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারে তো মানুষ মারা যেতে পারে। তারা তো জাতিকে বলছে যে বন্দুকযুদ্ধে জনগণের কেনা বুলেটেই ‘দুর্বৃত্তদের’ প্রাণ যায়। তার পরিসংখ্যান তাহলে তারা প্রকাশ করবে না কেন?
তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে চাইলে রাষ্ট্রকে ধারণ করতে হবে যে মানুষ মেরে কেউ অপরাধ কমাতে পারেনি। অবশ্য রাষ্ট্র যে অপরাধ কমানোর জন্যই এটা করে থাকে, সেটিই–বা বলি কী করে? কারণ, বিচার বিভাগের মাধ্যমে তো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তাদের আগ্রহ দেখি না। বাহিনীগুলোর কত শান–শওকত, বাজেট বাড়তেই থাকে। আদালতেরটা বাড়ে না। ফৌজদারি ম্যাজিস্ট্রেসি প্রশাসনের খরচের সঙ্গে সাধারণ প্রশাসনের খরচের একটা তুলনাই বলে দেবে এই রাষ্ট্রের মতিগতি কী বা তারা কী চায়।
গত অধিবেশনে একটা মজার ঘটনা ঘটে। বিরোধীদলীয় সাংসদেরা আইন মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ এক টাকা করার দাবি জানিয়ে নোটিশ দেন। এটি একটি অভাবনীয় ঘটনা। জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, ‘স্বল্প বিচারক দিয়ে ৩০ বছরেও মামলাজট খুলবে না।’ এই রাষ্ট্রের এলিট ফোর্স দরকার, কিন্তু এলিট কোর্টের দরকার নেই।
জাপা থেকে বর্তমান সরকারে সাবেক মন্ত্রী মুজিবুল হক রসিক মানুষ। বলেছেন, ‘আইনমন্ত্রী দক্ষ মানুষ। তিনি টাকা কম চেয়েছেন কেন। তাই এক টাকা দিতে প্রস্তাব এনেছি।’ আইনমন্ত্রীও কম যান না। তিনি বলেছেন, ‘আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা চাইলেও বলেন ১ হাজার কোটি নেন। ২ হাজার কোটি টাকা চাইলে তো ওনারা হার্টফেল করতেন। তাই আস্তে আস্তে চাচ্ছি। কাজ দেখিয়ে অর্থমন্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে চাই।’ বিচার বিভাগীয় অসহায়ত্বের এ যেন ধ্রুপদি বহিঃপ্রকাশ। রাষ্ট্রের চরিত্র কেমন, সেটা বুঝতে এর আগে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে সংসদে দুই বড় দলের নবতর ঐক্য বিবেচ্য। বিএনপির এই দায় সরকারের প্রতি নয়, রাষ্ট্রের প্রতি। তারা এই রকম রাষ্ট্রকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, যারা ক্রসফায়ারে, গুমে, চোখ বেঁধে অপহরণে, বিদেশে ফেলে দিতে, রিমান্ডে নির্যাতনে বিশ্বাসী।
এ অবস্থা বদলের সঙ্গে রাষ্ট্রের চরিত্র বদলের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। হুকুম দিয়ে বেছে বেছে অপরাধী দমন, নাকি আইনের শাসনের শর্তে সব অপরাধী দমন, এর একটিকে বেছে নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে অবশ্যই বলব, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাষ্ট্র ক্রমাগতভাবে কঠোর থেকে কঠোরতম দণ্ড আরোপের দিকে এগিয়েছে। যত নতুন আইন, ততই কঠোর শাস্তি। কিন্তু তারা দেখেছে, এগুলোর সবটাই ব্যর্থতা দিয়ে চলছে। বিশ্ব যখন মৃত্যুদণ্ড বাতিলের দিকে গেছে, ভারত ও পাকিস্তান যখন মৃত্যুদণ্ডে মোরাটরিয়াম বা বিরতিকাল মেনেছে, তখন আমরা ‘বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ড’ আইনে এনেছি। ভারত ২০১২ সালের আগে টানা আট বছর কোনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেনি। তাই বলে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল, এমন দাবি কেউ করেনি। ২০১২ সালের পর থেকে ভারতে শান্তি নামের দুধের নহর বইছে, এ কথাও কেউ বলছে না।
সভ্যতার দাবি মৃত্যুদণ্ডপ্রথা বিলোপ করা। আর আমরা কোথায় যাচ্ছি? আশার বিরুদ্ধে আশা করব। প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী প্রধান গত ১০ সেপ্টেম্বর সংসদে বলেছেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শুরু ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ যথাক্রমে জিয়া ও খালেদা জিয়ার আমলে। আমরা (আওয়ামী লীগ) এর ধারাবাহিকতা বন্ধ করার চেষ্টা করছি।’ আমরা জানি না বন্দুকযুদ্ধশূন্য সেপ্টেম্বরের সঙ্গে এর কোনো মিল আছে কি না। তবে এটুকু বলব, সংসদ নেতার এই উক্তির সঙ্গে সংসদের ফ্লোরে দুই দলের কিছু সদস্যের উক্তির মিল নেই। আইনসম্মত বন্দুকযুদ্ধের শোর তুলে সেদিন তাঁরা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। সংবিধানের বিরোধিতা সংসদের মধ্যে করলে তা শাস্তিযোগ্য হবে না, এমন কথা সংবিধান বলে না। এখানে সাংসদদের বাক্স্বাধীনতা নেই। উপরন্তু আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ রাজনীতিক ও সাংসদ এই সেপ্টেম্বরেই আইন করে বন্দুকযুদ্ধের বৈধতা চেয়েছেন।
সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ বলেছে,‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ ২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীতে আনা সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদের খ উপদফা বলেছে, ‘“এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে” তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।’
অন্তত সংসদীয় কার্যপ্রণালি থেকে বন্দুকযুদ্ধের সপক্ষে উল্লিখিত ‘দ্বিদলীয় দ্বিচারিতার’ অংশটুকু এক্সপাঞ্জ (রহিত) করা হোক।
আপনার মতামত জানানঃ