রাশিয়ান সীমান্ত থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরে এস্তোনিয়ায় বড়-মাত্রার সামরিক মহড়া শুরু করেছে সামরিক জোট ন্যাটো। সোমবার ‘হেজহগ ২০২০’ নামের এই মহড়া শুরু হয়। ন্যাটো সূত্রে জানা যায়, বাল্টিক দেশগুলোর ইতিহাসে এটি অন্যমত বৃহত্তম মহড়া।
এই মহড়ায় ন্যাটোর সদস্য এবং সহযোগীসহ মোট ১৪টি দেশের অন্তত ১৫ হাজার সেনা অংশ নেবেন বলে জানানো হয়েছে। সোমবার রাশিয়ান সংবাদমাধ্যম আরটি এই খবর প্রকাশ করেছে।
ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ইলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই মহড়ায় অংশ নেওয়া সেনাদের মধ্যে ফিনল্যান্ড, সুইডেন, জর্জিয়া এবং ইউক্রেনের সেনা রয়েছেন। সামরিক বাহিনীর সব শাখা এই মহড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং আকাশ, জল এবং স্থলপথে মহড়ায় অংশ নেবেন সেনারা। এ ছাড়া সাইবার যুদ্ধের বিষয়েও প্রশিক্ষণ নেবেন মহড়ায় অংশ নেওয়া সৈন্যরা।
ন্যাটো এক বিবৃতিতে জানায়, এই মহড়ায় মার্কিন নৌবাহিনীর ওয়াস্প-ক্লাস ল্যান্ডিং শিপ ‘কিয়ারসার্জ’-কেও অংশ নিতে দেখা যাবে। তবে রাশিয়ান সীমান্তের ৬০ কিলোমিটার দূরে শুরু হওয়া এই মহড়ার সঙ্গে ইউক্রেনে চালানো মস্কোর সামরিক অভিযানের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছে ন্যাটো এবং এস্তোনিয়ার প্রতিরক্ষা বাহিনীর মেজর জেনারেল ভেইকো-ভেল্লো পাম।
এদিকে এই সামরিক মহড়াটি এমন এক সময়ে শুরু হলো যখন নর্ডিক দেশ ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে এবং সদস্যপদ পেতে আনুষ্ঠানিক আবেদন করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে পশ্চিমা কর্তৃপক্ষ বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই এই মহড়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
এস্তোনিয়ায় হওয়া এই মহড়া রাশিয়ান সীমান্তের কাছে হওয়া ন্যাটোর বড় মাত্রার সামরিক কর্মকাণ্ডের একটি অংশ মাত্র। আরেক বাল্টিক দেশ লিথুনিয়ার আয়োজনে চলছে ‘আইরন ওলফ’ নামে সামরিক মহড়া, যেখানে ন্যাটোর তিন হাজার সেনার পাশাপাশি এক হাজার সামরিক সরঞ্জামও ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে জার্মানির লিওপার্ড ট্যাঙ্ক-২ ও আছে।
অন্যদিকে শুক্রবার দেওয়া ন্যাটোর এক বিবৃতিতে জানা যায়, ন্যাটোর বৃহত্তম দুটি মহড়া ‘ডিফেন্ডার ইউরোপ’ এবং ‘সুইফট রেসপন্স’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে পোল্যান্ডসহ আটটি দেশে। এই মহড়ায় ২০টি দেশের ১৮ হাজার সেনা অংশ নিচ্ছেন।
ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদান
এদিকে, ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাটো জোটে যোগদানের জন্য আজ (১৮ মে) মিত্র সদর দপ্তরে আবেদন করেছে।
বুধবার ব্রাসেলসে একটি অনলাইন ভিডিও অনুষ্ঠানে সুইডিশ এবং ফিনিশ রাষ্ট্রদূতরা আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গের কাছে আবেদনপত্র জমা দেন।
আবেদনপত্র গ্রহণের সময় স্টলটেনবার্গ বলেন, এই পদক্ষেপটি ইউরোপীয় নিরাপত্তার জন্য একটি ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’।
তিনি বলেন, “ন্যাটোতে যোগদানের জন্য ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের আবেদনকে আমি আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। আপনারা আমাদের নিকটতম অংশীদার, এবং ন্যাটোতে আপনাদের সদস্যপদ আমাদের সকলের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করবে।”
আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে চলা স্নায়ুযুদ্ধের সময় সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড উভয়ই নিরপেক্ষ ছিল। এই দুটি দেশের ন্যাটোতে যোগদানের সিদ্ধান্ত কয়েক দশক ধরে ইউরোপের নিরাপত্তার বিষয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলির মধ্যে একটি।
চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে নর্ডিক অঞ্চলে জনমতের ব্যাপক পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করে এই সিদ্ধান্ত।
চীন-তুরস্ক-রাশিয়ার হুঁশিয়ারি
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগদানকে সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখছে না রাশিয়া। তবে দেশ দুটিতে সামরিক অবকাঠামো স্থাপনে হয়তো মস্কোর পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া দেখানোর আশঙ্কা বাড়াবে।
সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে সামরিক অবকাঠামো সম্প্রসারণ করা হলে, ন্যাটোকে অবশ্যই জবাব দেয়া হবে বলে সতর্ক করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। যদিও এ পরিস্থিতির মধ্যেই রুশ সীমান্তের কাছে বড় ধরনের সামরিক মহড়া শুরু করেছে ন্যাটো।
এদিকে, পুতিন বলেন, নর্ডিক জাতিদের ন্যাটো সদস্যপদ আমাদের জন্য সরাসরি হুমকি নয়… তবে এই অঞ্চলে সামরিক অবকাঠামো সম্প্রসারণ নিশ্চিতভাবেই আমাদেরকে প্রতিক্রিয়া দেখাতে উসকানি দেবে। সোমবার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এই খবর প্রকাশ করেছে।
সোমবার মস্কোর নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিয়েটি অরগানাইজেশনের সম্মেলনে টেলিভিশনে সম্প্রচারকৃত বক্তৃতায় পুতিন এসব কথা বলেন।
এ ছাড়া রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ পশ্চিমাদের সতর্ক করে বলেছে, দেশটি স্বাভাবিকভাবে তার সীমান্তের কাছে ন্যাটোর সম্প্রসারণের মাধ্যেমে সামরিক অবকাঠামো নির্মাণ করতে দেবে না।
এদিকে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ এরদোগান বলেছেন, ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন সন্ত্রাসী সংগঠন সম্পর্কে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। তুরস্কের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা দেশগুলোকে আঙ্কারা সমর্থন দেবে না সাফ জানিয়ে দেন তুর্কী প্রেসিডেন্ট।
ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ নিয়ে সোমবার নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চীন। তবে তাদের প্রতিক্রিয়া বা বার্তা ছিল অস্পষ্ট। সোমবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ানের কাছে ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়।
এ প্রশ্নের উত্তরে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার বিষয়টি জেনেছে চীন। ফিনিশ-চাইনিজ সম্পর্ক সব সময় ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার জন্য ফিনল্যান্ড আবেদন করলে অবশ্যই এ সম্পর্কে ‘নতুন ফ্যাক্টর’ যুক্ত হবে।
নতুন ফ্যাক্টর যুক্ত হবে এটি দিয়ে কি বুঝিয়েছেন? এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয় চীনের এ মুখপাত্রকে। কিন্তু তিনি এর ব্যাখ্যা দেননি।
তবে ফিনল্যান্ডের একজন সাংবাদিক চাপাচাপি করলে মুখপাত্র লি বলেন, উত্তরদিকে ন্যাটোর পরিধি বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে চীনের অবস্থান সব সময় পরিস্কার।
এদিকে চীন সব সময় ন্যাটোর পরিধি বাড়ানোর বিষয়টির সমালোচনা করেছে। চীনের বিশেষজ্ঞরাও ন্যাটোর পরিধি বাড়ানোর বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে না।
রাশিয়ার গণমাধ্যশ তাস নিউজ গত সপ্তাহে জাং গুকিং নামে একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে। সেই বিশেষজ্ঞ জানান ফিনল্যান্ড সুইডেন ন্যাটোতে যোগ দিলে ওই অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বাড়বে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫৭
আপনার মতামত জানানঃ