দেশে করোনাকালে যেসব খাতের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে, তার মধ্যে একটি হলো শিক্ষা। করোনা সংক্রমণ শুরুর দুই বছর পর এখন সেই চিত্র উঠে আসছে। সরকারের নতুন তথ্য বলছে, করোনাকালে এক বছরের ব্যবধানে প্রাথমিকে মোট শিক্ষার্থী কমেছে সাড়ে ১৪ লাখের বেশি। এর মধ্যে প্রাক্-প্রাথমিক স্তরে আট লাখের বেশি শিশুশিক্ষার্থী কমেছে। অথচ প্রতিবছর শিক্ষার্থী বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। সারা দেশে প্রাথমিক স্তরে বিদ্যালয়ের সংখ্যাও কমেছে। বিদ্যালয় কমেছে মূলত বেসরকারি খাতের।
করোনাকালে দুই দফায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ সময় দেশের স্কুলে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমেছে, অপরদিকে মাদ্রাসায় বেড়েছে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২১ সালের খসড়া প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়, যা আনুষ্ঠানিকভাবে চলতি মাসে প্রকাশের কথা রয়েছে।
প্রাথমিকে কমছে শিক্ষার্থী
করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে দ্বিতীয় দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে ক্লাস বন্ধ করা হয় গত ২১ জানুয়ারি। সে দফায় শিক্ষাঙ্গনে সশরীরে ক্লাস বন্ধ থাকে এক মাস। ২২ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাঙ্গনগুলো আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে।
গত ২ মার্চ শুরু হয় প্রাথমিকে সশরীরে ক্লাস। টানা দুই বছর বন্ধের পর গত ১৫ মার্চ প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের সশরীরে ক্লাস শুরু হয়।
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর দুই দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়। প্রথম দফায় প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে শিক্ষাঙ্গনের দুয়ার।
করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে গত দুই বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এবং বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি। অ্যাসাইনমেন্টের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে সব শিক্ষার্থীকে ওপরের শ্রেণিতে ওঠানোর সুযোগ দেওয়া হয়। ফলে ঝরে পড়ার হার কমেছে। একই সঙ্গে দুই বছর ধরে বিদ্যালয়গুলোতে ছুটি থাকায় অনেক শিশু বিশেষ করে প্রাক্-প্রাথমিক স্তরের অনেক শিশু ভর্তিই হয়নি। এর ফলে মোট শিক্ষার্থী কমতে পারে।
বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঁচ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের জন্য এক বছর মেয়াদি প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা চালু আছে; যেটি ‘শিশু শ্রেণি’ নামে পরিচিত। এক বছর প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ছয় বছরের বেশি বয়সী শিশুদের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়।
এর আগে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২১ সালের তথ্য নিয়ে করা প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছিল, ২০২১ সালে মাধ্যমিকে মোট শিক্ষার্থী আগের বছরের তুলনায় ৬২ হাজার ১০৪ জন কমেছে। বর্তমানে দেশে মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২০ হাজার ২৯৪টি।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থী ছিল ২ কোটি ১ লাখের বেশি। যা ২০১৮ সালে ছিল ২ কোটি ৯ লাখ ১৬ হাজার।
বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারির তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে সরকারি ও বেসরকারি (কিন্ডারগার্টেনসহ) মিলিয়ে দেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় কমেছে ১৪ হাজার ১১১টি। ২০২১ সালে বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯১টি, যা আগের বছর ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ২টি। মূলত কিন্ডারগার্টেনসহ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ই কমেছে।
বেড়েছে মাদ্রাসাশিক্ষার্থী
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) থেকে জানা যায়, ২০২১ সালের খসড়া জরিপ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে মাদ্রাসার সংখ্যা ৯ হাজার ২৯১টি। এতে শিক্ষার্থী রয়েছে ২৬ লাখ ৫৭ হাজার ২৫২ জন, যা ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ছিল ২৫ লাখ ৫৩ হাজার ৪৩৯ জন। সেই হিসাবে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী বেড়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৮১৩ জন। এ পরিসংখ্যান শুধু আলিয়া মাদ্রাসার জন্য প্রযোজ্য। কারণ ব্যানবেইসের কাছে কওমি মাদ্রাসার কোনো তথ্য নেই।
করোনাকালে দুই দফায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ সময় দেশের স্কুলে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমেছে, অপরদিকে মাদ্রাসায় বেড়েছে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা।
খসড়া প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালের প্রতিবেদনে মাদ্রাসার সংখ্যা কমার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে মাদ্রাসার সংখ্যা ৯ হাজার ২৯১টি, যা ২০২০ সালে ছিল ৯ হাজার ৩০৫টি। সেই হিসাবে মাদ্রাসা কমেছে ১৪টি।
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখন মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ১ লাখ ৯০ হাজার ২২ জন, যা ২০২০ সালে ছিল ১ কোটি ২ লাখ ৫২ হাজারের বেশি।
জানতে চাইলে ব্যানবেইসের প্রধান পরিসংখ্যানবিদ মো. আলমগীর বলেন, ‘তথ্যগুলো এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আশা করছি চলতি মাসেই ২০২১ সালের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। তখন বিষয়টির বিস্তারিত বলা যাবে।’
মাদ্রাসার শিক্ষার্থী বাড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের খসড়া প্রতিবেদনে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বাড়ার তথ্য পেয়েছি। যার বিস্তারিত মূল প্রতিবেদনে থাকবে।’
কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর তথ্য জানতে চাইলে মো. আলমগীর বলেন, ‘আমরা এবার আমাদের ডাটাবেজে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের তথ্য অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কওমি মাদ্রাসাগুলোর অসহযোগিতার জন্য তা সম্ভব হয়নি।’
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
করোনার কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং অনেক অভিভাবকের আর্থিক অনটনের কারণে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বাড়ছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
করোনার কারণে অনেক পরিবারে আর্থিক দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এটাও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বাড়ার অন্যতম কারণ। এছাড়া সামাজিক নানা প্রেক্ষাপট তো রয়েছেই।
শিক্ষাবিদরা বলেন, ‘মূলত দুটি কারণে অভিভাবক তার সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়াতে আগ্রহী হয়। একটি ধর্মীয় চিন্তা, অন্যটি আর্থিক অসংগতি। করোনার ফলে অনেক অভিভাবকের আর্থিক টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। এটাও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বাড়ার অন্যতম কারণ।’
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা দিনকে দিন কমছে। অবস্থা আশঙ্কা জনক বলে মনে করছেন শিক্ষকরা।
তারা বলছেন, এ প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে শহরতলী ও গ্রামের স্কুলগুলোতে।
এর কারণ প্রসঙ্গে প্রাথমিকের একাধিক শিক্ষক নেতা জানান, করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকলেও মাদ্রাসা খোলা থাকা, প্রাথমিকে নিচের শ্রেণিতে ধর্মীয় পাঠ না থাকায় শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসা গমনের প্রবণতা, পরিকল্পনা ছাড়া ও কোনোরূপ অনুমতি ব্যতিরেকে নুরাণী মাদ্রাসা গড়ে তোলা, অভিভাবকদের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে শিশুদের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিমুখ করছে মাদ্রাসাগুলো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্কুল প্রধান শিক্ষক অভিযোগ করেন, করোনার অতিসংক্রমণকালে সব স্কুল বন্ধ করে কেবল হিফজ মাদ্রাসা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত ছিল। এ সুযোগে অন্যান্য মাদ্রাসাগুলো খোলা রেখে অভিভাবকদের প্রভাবিত করেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ