অপরাধী যত বড় ও ঘৃণ্য অপরাধই করুক না কেন, বাংলাদেশের সংবিধান তাকে আইনের আশ্রয় কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে না। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ ধারায় স্পষ্ট করে বলা আছে, ‘বিশেষত, আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’
গত এপ্রিলে কুমিল্লায় র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত মোহাম্মদ রাজুর বাবা সন্তানের মৃত্যুর পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার সন্তান অপরাধ করে থাকলে দেশে আইন ছিল, আদালত ছিল। সেখানে তার বিচার করতে পারত। কোনো যাচাই-বাছাই তদন্ত ছাড়া আমার ছেলেকে র্যাব মেরে ফেলল!’ তিনি আরও জানান, তিনি মামলা করবেন না এবং কোনো বিচার চাইবেন না। এ রকম অনেক বাবা তার সন্তান হারানোর চাপা কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছেন এদেশে। অনেক সন্তান তার বাবাকে হারিয়ে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে এদেশে। যদিও তারা সন্ত্রাসীদের হাতে নয়, মারা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।
এর পাশাপাশি গত বছর জুন মাসে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে ওঠা হেফাজতে নির্যাতন ও নিষ্ঠুর আচরণের ব্যাপকভিত্তিক অভিযোগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে দেশটির সরকার; এমন উল্লেখ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-সহ দশটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা জাতিসংঘ ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতি চূড়ান্ত ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানায়।
মানবাধিকার বিষয়ক দশটি আন্তর্জাতিক সংস্থার একটি যৌথ বিবৃতিতে বন্দীদের উপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর যেসব নির্দয় আচরণের উল্লেখ আছে, তার মধ্যে রয়েছে লোহার রড, বেল্ট এবং লাঠি দিয়ে পেটানো; কানে এবং যৌন অঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেয়া, মুখ আটকে পানি ঢালা (ওয়াটার বোর্ডিং), ছাদ থেকে ঝুলিয়ে পেটানো, পায়ে গুলি করা, কানের কাছে জোরে শব্দ করা বা গান বাজানো, পায়ের তালুর নীচে সূচালো বস্তু রাখা, মৃত্যু কার্যকরের নাটক সাজানো এবং নগ্ন করে রাখার মতো ঘটনা।
শত শত মানুষ গুম বা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে বলে বলা হয়েছে ওই বিবৃতিতে। এর সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানা যায়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের মে পর্যন্ত ‘নির্যাতনে’ ১০১ জনের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার।
এদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হলো সন্ত্রাসীদের লিগ্যালাইজড একটা চেহারা।২০২০ সালে সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্মমভাবে পিটিয়ে যুবক হত্যার দায়ে অভিযুক্ত পলায়নরত এসআই আকবরকে সীমান্তবর্তী খাসিয়াপল্লির স্থানীয় যুবকেরা ধরে জিজ্ঞেস করেছিল—‘তুমি মারবার অধিকার পাইলা কই?’ বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের মনে আসলে এই একই প্রশ্ন আছে। ‘তুমি মারবার অধিকার পাইলা কই?’ ‘তুমি ক্রসফায়ার দেওয়ার অধিকার পাইলা কই?’ ‘তুমি গুমের অধিকার পাইলা কই?’।
জবাবদিহিবিহীন ক্ষমতা যে কতটা দুরন্ত হতে পারে, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল নারায়ণগঞ্জে কর্তব্য পালনরত র্যাবের একটি ইউনিটের আচরণে। একসঙ্গে সাতজন মানুষকে তারা নিজ হাতে মেরে নদীতে নিয়ে ফেলে দিয়েছিল। লাশগুলো বেয়াদপি করেছে, ভেসে উঠেছে, নইলে গোটা ঘটনাটিই ডুবে যেত, হয়তো আর খবরই পাওয়া যেত না। নিহতদের মধ্যে ঘটনাক্রমে একজন আইনজীবীও ছিলেন, যার জন্য অন্য আইনজীবীরা হৈচৈ করেছেন; লাশগুলোর ভাসমান অস্তিত্বের সঙ্গে ওইসব ধ্বনি একত্র হয়ে বিচার দাবি করার দরুন নানা টালবাহানা সত্ত্বেও বিচার শেষ পর্যন্ত একটা হয়েছে, ফাঁসির হুকুম হয়েছে ২৬ জনের, যাদের অধিকাংশই র্যাবের সদস্য। র্যাব যে আক্রমণের মুখে আত্মরক্ষার জন্য মানুষগুলোকে খুন করেছে তা নয়; র্যাবের ওই ইউনিটটি ভাড়া খাটছিল মূল অপরাধীর হাতে। অর্থাৎ কি-না তারা পরিণত হয়েছিল ভাড়াটে খুনিত। ভাবা যায়? এই ইউনিটের কমান্ডার ছিলেন যিনি তার শ্বশুর আবার আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতা ও সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী। ক্ষমতার এই চাপের নিচে পড়ে নিহত মানুষগুলোর পক্ষে বাঁচার কোনো উপায় ছিল না। তারা বাঁচেননি। র্যাব বলেছিল, অপরাধটা বাহিনীর নয়, বিপথগামী কিছু সদস্যের। বলাটা স্বাভাবিক। তবে প্রশ্ন থেকে যায়। এই বিপথগামীরা যে বিপথে ঘোরাফেরা করছিল, বাহিনী কি সেটা টের পায়নি? টের পেয়ে যদি নিবারণের পদক্ষেপ নিয়ে না থাকে, তবে সেটা যেমন বিচ্যুতি, জেনেও যদি না-জেনে থাকে, তবে সেটা আরও বড় বিচ্যুতি। দুটির কোনোটিই গ্রহণযোগ্য নয়। (১০ সেপ্টম্বর, ২০১৯; সমকালে-সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী)
সারাদেশের অপরাধীদের ওপর যারা চোখ রেখেছে, তারা যদি নিজেদের ঘরের অপরাধীদের খবর না রাখে, তবে ঘটনা তো রীতিমতো বিপজ্জনক। আর যখন দেখা যাচ্ছে যে, অপরাধ করার পরও তাদের বিরুদ্ধে বাহিনীর নিজের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তখন তো ব্যাপারটা সত্যি সত্যি আতঙ্কজনক।
সন্ত্রাস দমনে সাহসী এবং সফল ভূমিকা রেখে মানুষকে নিরাপত্তা আর স্বস্তি দিয়ে র্যাব শুরুতে জনগণের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সময়ের পরিক্রমায় র্যাবের প্রতি মানুষের আস্থায় চিড় ধরেছে। বিশেষ করে, ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমনকে গুলি এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর একটি পা কেটে ফেলা, কক্সবাজারের একরামুল হককে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
দেখা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে র্যাব সরকারের আস্থাভাজন বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে আর জনগণের সঙ্গে এই এলিট বাহিনীর দূরত্ব বাড়তে থাকে। যখন যে সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, র্যাব তার প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছে আর বিরোধীদের সমালোচনা ও বিরোধিতার মুখে পড়েছে। এমনকি বর্তমান সরকারও বিরোধী দলে থাকতে এটিকে সংবিধান পরিপন্থী বলে আখ্যা দিয়েছে এবং তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে।
বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নাগরিক সমাজ, দেশি ও বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা কিংবা আইন-বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অসাংবিধানিক। কারণ, এটি আইনের শাসনের মূল ধারণার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ এবং বাংলাদেশ সংবিধানের মানবাধিকার-সংক্রান্ত ধারাগুলোর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। দুর্ভাগ্যবশত, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর এবং উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মোকাবিলায় গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র র্যাব এবং এই বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অনেকেই মনে করছেন, এই নিষেধাজ্ঞা দেশের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের মাত্রা বিবেচনায় এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন ছিল। এ ধরনের ঘটনা একটি গণতান্ত্রিক সমাজে আইনের শাসনের মৌলিক নীতিগুলোর স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইনি বাধ্যবাধকতার পরিপন্থী।
আন্তর্জাতিক চুক্তি আইন, যেমন ২০০০ সালে বাংলাদেশ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিসিপিআর) অনুস্বাক্ষর করে, যেখানে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা, এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের এবং তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করার বাধ্যবাধকতা আছে। এ ছাড়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করা হোক বা না হোক, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত করার জন্য রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা বন্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে জনগণের মনে আশার সঞ্চার করেছে এবং বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পরিবারের মনে আশা জাগিয়েছে। নিষেধাজ্ঞার পর গত পাঁচ মাসে দুই–একটি ছাড়া জানা মতে, দেশে কোথাও ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। যা থেকে স্পষ্ট হয়, এই নিষেধাজ্ঞা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
এই নিষেধাজ্ঞা সরকারকে একধরনের অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে, সেটি তাদের কর্মকাণ্ডে স্পষ্ট। সরকারের বিদেশ কূটনীতির মূলে এখন এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। শুধু কূটনৈতিক চ্যানেল নয়, সরকার যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ থেকে শুরু করে আইনবিদ নিয়োগ করে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি এটি প্রত্যাহারে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের শরণাপন্ন হতেও দ্বিধা করেনি। প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে এখন এত আদাজল খেয়ে লাগল, তাহলে এত দিন কেন এত নির্বিকার থেকেছে? এই নিষেধাজ্ঞা কি এতটা অপ্রত্যাশিত ছিল?
র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা র্যাবের কর্মকাণ্ড নিয়ে অসন্তোষ জানিয়ে আসছিল। মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সমালোচনার পর যুক্তরাজ্য সরকার র্যাব সদস্যদের জন্য তার সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ প্রত্যাহার করে নেয়। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রও তার সহযোগিতা কমিয়ে আনে। এসব নিয়ে সরকার গুরুত্ব দেয়নি বরং বারবার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে গেছে। ফলে দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও অন্যান্য ঘটনার মাত্রা আরও বেড়েছে।
বরাবরের মতোই সরকার এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়ে এটি প্রত্যাহারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। তবে যে বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং র্যাবের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করা। এতে সরকারের ভাবমূর্তি বাড়বে, মানবাধিকার রক্ষায় তাদের অঙ্গীকার সমুন্নত হবে এবং এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অন্যথায়, এই নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘায়িত হলে কিংবা এর পরিধি বিস্তৃত হলে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে, দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যা এ দেশের জনগণের জন্য কল্যাণকর হবে না।
এসডব্লিউ/এসএস/২০১২
আপনার মতামত জানানঃ