বান্দরবানে লামা উপজেলার সরই এলাকায় ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ৩০০ একর জুমচাষের জমি ও প্রাকৃতিক বন পুড়ে ছাই হয়েছে।
পাড়াবাসীর অভিযোগ, ২৬ এপ্রিল লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি রাবার কোম্পানি তাদের পাড়া থেকে উচ্ছেদ করতে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগায়।
সূত্র মতে, লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া ও লাংকম ম্রো পাড়া দুটির একই জায়গায় অবস্থান। সেখান থেকে মিনিট দশেক হাঁটার দূরত্বে রেংয়াং ম্রো পাড়া। তিনটি পাড়ায় মোট ৩৯টি পরিবার রয়েছে। পাড়াবাসীদের সবাই জুমচাষী। কিছু পরিবার ফলদ বাগান করে জীবিকা নির্বাহ করে।
পাড়ার আশপাশে প্রাকৃতিক বন জঙ্গল ও জুমচাষের জমি সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়ে গোটা এলাকাজুড়ে বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। আগুনে গাছপালা ও লতাগুল্ম জাতীয় পুড়ে ছোট ছোট ঝিরিতে পানিও কমে গেছে। পানি সংকটের পাশাপাশি পরিবেশ ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে গোটা এলাকায়।
যেভাবে পুড়ল ৩০০ একর জমি ও প্রাকৃতিক বন
জয়চন্দ্র পাড়ার বাসিন্দা যোহন ত্রিপুরা বলেন, ‘২৬ এপ্রিল পাড়ার উত্তর দিকে বাঁশফাটা শব্দ শুনে গিয়ে দেখি আগুন লেগেছে। সেখানে সবাই জড়ো হয়ে আগুন নিভানোর চেষ্টা করছিল। পরে দেখা গেল, আমাদের পাড়ার পশ্চিম দিক থেকে আগুন লাগা শুরু হয়েছে। একই সময়ে কয়েকটি জায়গা থেকে আগুন লাগার মাধ্যমে বোঝা যায় এটা একটা পরিকল্পিত ঘটনা।’
‘প্রথম আগুন লাগার ঘটনাস্থলে রাবার কোম্পানির দশ থেকে পনের জন লোক দেখতে পাই। তারা আগুন লাগার ঘটনা বারবার অস্বীকার করে। কিন্তু দেখা যায় আগুন লাগার সময় বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও ৬০ জনের মত শ্রমিক পাহারা দিচ্ছিল।’
যোহন ত্রিপুরা বলে, সেদিন সকাল দশটা থেকে শুরু হয়ে রাত দশটা পর্যন্ত আগুন জ্বলছিল। চারদিকে এত আগুন কারও কোন নিভানোর সাধ্য ছিল না।
একই পাড়ার বাসিন্দা বিশ্বচন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, পরে আগুন জ্বলতে জ্বলতে পাড়ার কাছাকাছি চলে আসে। ভয়ে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। চারদিকে আগুন দেখে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছিল। লোকজনের যার যার ঘরের চালে উঠে পানি নিয়ে থাকতে হয়েছিল, যাতে ঘরে আগুন লাগলে নিভানো যায়।’
পাড়ার অদূরে তিন পাড়াবাসী দীর্ঘদিন ধরে একই কবরস্থান ব্যবহার করে আসছে। বাঁশের ঘের দেওয়া এই কবরস্থানও আগুনে পুড়ে যায়। এছাড়া সবার ব্যবহারের জন্য সামাজিকভাবে তৈরি করা ৩০ একর পাড়াবনের মধ্যে ২৫ একর বাঁশ ও কাঠ পুড়ে যায়।
লাংকম ম্রো পাড়ার বাসিন্দা রেংয়ং ম্রো অভিযোগ করে বলেন, তার ১৫ একরের জায়গায় একাশি ও ম্যালেরিয়া গাছ, আম ও কাজুবাদাম বাগান ছিল। এগুলো পুড়ে গেছে।
লাংকম ম্রো পাড়ার আরেক বাসিন্দা বলেন, তার নিজের তিন একরের জায়গায় কলা, কাজুবাদাম ও আম গাছ ছিল। একাশি গাছ ছিল ৫০০টির মত। সেগুলো রাবার কোম্পানির লোকজন আগেই কেটে দিয়েছিল। বাকিগুলো সেদিন আগুনে পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে যায়।
নেপথ্যে কারা?
এই তিন পাড়াবাসীর অভিযোগ, করোনা ভাইরাসের কারণে দেশে প্রথম লকডাউন চলাকালীন পাহাড়িদের ঐতিহ্য অনুযায়ী পাড়া বন্ধ চলছিল। সেসময় পাড়া বন্ধ ভেঙ্গে কোম্পানির লোকজন সব গাছ কেটে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।
তারা জানান, দুই মাস আগে পাড়ার ৩০০ একরের জায়গায় প্রথমে তাদের লাগানো গাছ, প্রাকৃতিক বন ও লতাগুল্ম কেটে দিয়ে যায়। পাড়াবাসী সবাই বাধা দিলে তারা চলে যায়। কেটে দেওয়া এসব গাছগাছালি ও লতাপাতা শুকানোর পর সুযোগ বুঝে এই সময়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে লাংকম ম্রো পাড়ার কারবারি (গ্রামপ্রধান) লাংকম ম্রো অভিযোগ করে বলেন, ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তিন পাড়া মিলে মোট ৮০ পরিবার ছিল। কোম্পানির লোকজনের হয়রানি ও হুমকির কারণে ৪১টি পরিবার অন্যত্র চলে যায়। এখন তিন পাড়া মিলে মাত্র ৩৯ পরিবার রয়েছে।
‘২০১৯ সালে ৪০০ একর জায়গা থেকে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রি কোম্পানি ৯০ একর জায়গা দখল করে নিয়ে যায়। সেখানে রাবার চারা ও একাশি গাছ লাগিয়েছে তারা। আবার সে বছর আমাদের এলাকার ছয়জনকে আসামী করে লামা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করে। সে মামলাটি এখনও চলছে। এভাবে এত হয়রানি ও হুমকি নিয়ে আমরা কিভাবে টিকে থাকব!’
এসব বিষয়ে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল উদ্দিন দাবি করেন, তিনি ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে ৬৪টি প্লটে সরকার থেকে ১৬০০ একর জমি চল্লিশ বছরের জন্য লীজ নিয়েছেন। ২৬ এপ্রিল তাদের ৩০০ একর জায়গায় কাজুবাদাম ও বাগান করার জঙ্গল পুড়ানো হয়েছে। কিন্তু পাড়াবাসীদের ঘরের এতে কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
রাবার কোম্পানির এই মালিক দাবি করেন, ‘নিজের লীজের জায়গার মধ্যে আছি। আমরা লীজের বাইরে নাই।’
এদিকে ঘটনাস্থল ডলুঝিরি মৌজার হেডম্যান যোহন ত্রিপুরা বলেন, ‘রাবার কোম্পানি যেসব জমি লীজ পেয়েছেন, পরে পার্বত্য চট্টগ্রামে জমি বন্দোবস্ত বন্ধ হওয়ায় লীজ বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। আগুনে পুড়ানোর জায়গা সত্যিকার অর্থে কোন কোম্পানির নয়। এটা তিন পাড়ার বাসিন্দাদেরই জায়গা। এছাড়া যে পরিমাণ লীজ পেয়েছেন বলে রাবার কোম্পানি দাবি করছেন সে পরিমাণ জায়গা হওয়ার কথা না।’
এই এলাকায় জুমভূমি আগুন পোড়ানোর ঘটনায় বৃহস্পতিবার লামা উপজেলার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেছেন ভুক্তভোগী একজন ম্রো।
মামলার আসামি আরিফ হোসেন ও দেলোয়ার হোসেন নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন লামা থানা ওসি শহিদুল ইসলাম চৌধুরী।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভিন তিবরীজি জানান, এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে লামা উপজেলার এসিল্যান্ডকে পাঠানো হয়েছে। তাকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটিও করা হয়েছে। তদন্তের প্রতিবেদন পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ