বিশ্বে করোনার আগমনের পর থেকে যে কোনো কারণেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া কঠিনতর হয়ে উঠেছে। অভিবাসনপ্রার্থী মানুষের জন্য প্রায় আরও অসম্ভব হয়ে উঠেছে অনুমোদন পাওয়া। এজন্য অনেকেই ঝুঁকছে অনৈতিক প্রক্রিয়ায় অভিবাসনের প্রতি। আর এভাবে দেশান্তরি হতে গিয়ে অনেকেই মৃত্যুর মুখে পড়ছে। গত বছর বিশ্বজুড়ে রেকর্ডসংখ্যক অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে।
সমুদ্রপথে ইউরোপ পৌঁছাতে গিয়ে ২০২১ সালে তিন হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন কিংবা নিখোঁজ হয়েছেন। এ সংখ্যা ২০২০ সালের তুলনায় দ্বিগুন।
শুক্রবার(২৯ এপ্রিল) জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার প্রকাশিত এক রিপোর্টে এ তথ্য দেয়া হয়েছে। এতে অভিবাসীদের এমন দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু ঠেকাতে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ খবর দিয়েছে এনডিটিভি।
খবরে জানানো হয়, ২০২০ সালে আটলান্টিক ও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ প্রবেশের পথে ১ হাজার ৫৪৪ জন নিহত কিংবা নিখোঁজ হয়েছিলেন। তবে ২০২১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৭ জনে।
এ নিয়ে ইউএনএইচসিআর মুখপাত্র শাবিয়া মান্তু জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেন, উদ্বেগজনক হারে এ বছরের প্রথম থেকেও ৪৭৮ জন সমুদ্রে প্রাণ হারিয়েছেন। গত বছর ইউরোপ যাওয়ার পথে সব থেকে বেশি মানুষ মারা গেছেন ভূমধ্যসাগরের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলীয় রুটগুলোতে। এই দুই রুটেই ১ হাজার ৯২৪ জন মারা গেছেন। অপরদিকে উত্তর আফ্রিকা থেকে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার পথে মারা গেছেন ১ হাজার ১৫৩ জন।
মান্তু বলেন, যেসব নৌকায় করে এসব অভিবাসী সাগর পাড়ি দেন সেগুলো সাগরে চলার উপযোগী নয়। সেখানে গাদাগাদি করে সাগরে নামার কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। পশ্চিম আফ্রিকার মৌরিতানিয়া ও সেনেগাল থেকে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে যেতে প্রায় ১০ দিন সময় লাগে। এই দীর্ঘ সময়ে নৌকাগুলো রাস্তা হারিয়ে ফেলে কিংবা গভীর পানিতে ডুবে যায়। শুধু সমুদ্রপথ নয়, ভূমি দিয়ে ইউরোপ প্রবেশ করাও বেশ বিপজ্জনক বলে জানানো হয় জাতিসংঘের ওই রিপোর্টে।
২০২০ সালে আটলান্টিক ও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ প্রবেশের পথে ১ হাজার ৫৪৪ জন নিহত কিংবা নিখোঁজ হয়েছিলেন। তবে ২০২১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৭ জনে।
ইউএনএইচসিআর সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, কোভিড-১৯ মহামারি ও সীমান্ত বন্ধ থাকায় মরিয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীরা বিপজ্জনক যাত্রার পথ বেছে নিতে পারেন।
জাতিসংঘের সংস্থাটি সতর্ক করে দিয়ে আরও বলেছে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও যুদ্ধ, জলবায়ু পরবর্তন দেশ ছাড়তে এ বিপজ্জনক পথ বেছে নেওয়ার হার বাড়িয়ে দিতে পারে।
বিশ্ব সংস্থাটি বিপজ্জনক এ যাত্রা থামাতে ও মানব পাচারের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে।
বহু বছর ধরে বিভিন্ন দেশের অভিবাসন প্রত্যাশীরা অবৈধভাবে ইউরোপের প্রবেশের জন্য এ দু’টি পথ ব্যবহার করে আসছেন; তবে গত ২০১৫ সাল থেকে সমুদ্রপথে ইউরোপে যেতে ইচ্ছুক অভিবাসন প্রত্যাশীদের সংখ্যায় উল্লম্ফণ ঘটেছে এবং প্রতিবছরই এই সংখ্যা বাড়ছে।
শাবিয়া মান্তু বলেন, অভিবাসন প্রত্যাশীদের বহনকারী নৌকা বা নৌযানগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ত্রুটিযুক্ত, অসমতল ও অতিরিক্ত যাত্রীতে পূর্ণ থাকে। এ কারণে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে সেগুলোর ডুবে যাওয়ার হারও বেশি।
আমাদের এই প্রতিবেদনে ডুবে যাওয়া নৌকা ও নৌযানের যে সংখ্যা দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। গত বছর সাগরে ডুবে যাওয়া অনেক নৌকা ও নৌযান সম্পর্কিত কোনো খোঁজ আমরা পাইনি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে নৌযানডুবিতে প্রাণহানির ঘটনা বেড়েছে। এই অবৈধ অভিবাসীদের দলে বাংলাদেশিদের থাকার খবর আগেও এসেছে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, মানব পাচারকারীরা ইউরোপের উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র এর আগে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের তালিকায় শীর্ষে আছে বাংলাদেশ।
মানব পাচারের দিক থেকে আন্তজার্তিক সংস্থার তালিকাতে কেন বাংলাদেশ শীর্ষে? আমরা যদি এর কারণ খুঁজি তাহলে সর্বপ্রথম যে কারণটি আসবে তা হলো বেকারত্ব। দেশের বিপুল পরিমাণ বেকার ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ধারণা, বিদেশে গেলে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে। পারিবারিক সচ্ছলতা আসবে এই বিশ্বাস নিয়ে অবৈধ পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয় তারা। তাদের এই বিশ্বাসকে পুঁজি করে স্বার্থ হাসিল করে পাচারকারীরা।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের সূত্র মতে কক্সবাজার ও টেকনাফের ৮০টি পয়েন্ট দিয়ে মানব পাচার হয়। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার জন্য জন্য মানব পাচার কমানো যাচ্ছে না। মানব পাচারকারী চক্রের সাথে পুলিশ, সীমান্ত রক্ষীবাহিনী, প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের নেতাসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার হাত আছে বলে মনে করা হয়।
বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশের সিলেটসহ কিছু জেলার মানুষের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা আছে। সেটি হলো— আপনি যদি কোনোভাবে ইউরোপে যেতে পারেন, তাহলেই জীবনের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে যারা অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের জন্য রওয়ানা হন, তাদের অধিকাংশের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে এবং তাদের একটি বিপুল অংশ লিবিয়া থেকে নৌপথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশের চেষ্টা করেন
তারা বলেন, প্রতিবছর ইউরোপে যেসব বাংলাদেশি প্রবেশ করেন, তাদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ইউরোপে প্রবেশের জন্য প্রচুর টাকাপয়সা খরচ করতে হয় এবং পরিবার সেই টাকার যোগান দেয়। এ থেকে সহজেই ধারণা করা যায়, এই অনুপ্রবেশকারীদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। তারা এই বিষয়টিকে দেখছে একপ্রকার বিনিয়োগ হিসেবে। আগে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবার জমি বা বাড়ি নির্মাণের জন্য অর্থলগ্নি করতো, এখন তারা নতুন খাত হিসেবে ইউরোপ প্রবেশকে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরা যদিও বরাবরই বলে আসছেন, দারিদ্র্যের কারণে এই প্রবণতা বাড়ছে এবং দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়লে এটি কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক তৎপরতা ও উন্নয়ন যেমন বাড়ছে, সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতিবছর ইউরোপে অবৈধ অনুপ্রবেশের হারও।
আরও বলেন, বাংলাদেশের মানুষদের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের সমন্বয় প্রয়োজন। পাশাপাশি, দালালদের ও ভুয়া রিক্রুটিং এজেন্সির সদস্যদের গ্রেপ্তার ও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। পরস্পরকে দোষারোপ না করে ইউরোপ এবং বাংলাদেশ উভয়কেই এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৪
আপনার মতামত জানানঃ