ঈদুল ফিতর সামনে রেখে স্থল, নৌ, রেল কিংবা আকাশ— প্রতিটি পথেই সিন্ডিকেট করে যাত্রীদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। ঈদযাত্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ভাড়া পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও চাঁদাবাজেরা লুটে নিচ্ছে বলে অভিযোগ করে জরুরি ভিত্তিতে এ ভাড়া নৈরাজ্য ও পথে পথে যাত্রী হয়রানি বন্ধের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
বৃহস্পতিবার (২৮ এপ্রিল) সকালে ‘ঈদযাত্রায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি’ বন্ধের দাবিতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই দাবি জানান। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
লিখিত বক্তব্যে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘ঈদুল ফিতর সামনে রেখে স্থল, নৌ, রেল কিংবা আকাশ–প্রতিটি পথেই যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। শ্রমিকদের ঈদের বেতন-বোনাস দেওয়া হয় না। সেই টাকা ওঠানোর নামে যাত্রীদের থেকে বড় অ্যামাউন্ট সিন্ডিকেট করে আদায় করা হচ্ছে। সড়কপথে ৪০ কোটি ট্রিপে যাত্রীপ্রতি গড়ে ১০০ টাকা বাড়তি দিলেও প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা এবং নৌ, রেল ও আকাশপথে ২০ কোটি ট্রিপে যাত্রীপ্রতি গড়ে ২০০ টাকা অতিরিক্ত আদায় করা হলেও প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আদায় হবে। সব মিলিয়ে এবারের ঈদে ৮ হাজার কোটি টাকা বেশি ভাড়া সিন্ডিকেটের পকেটে যাবে।’
তিনি বলেন, এবারের ঈদে ২৫ এপ্রিল থেকে ১০ মে পর্যন্ত সবপথে প্রায় ৬০ কোটি ট্রিপ যাত্রী হতে পারে। তার সিংহভাগ অর্থাৎ ৪০ কোটি ট্রিপ সড়ক পথে, ২০ কোটি ট্রিপ রেল, নৌ ও আকাশ পথে যাতায়াত হতে পারে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২৫ এপ্রিলের পর থেকে শহরাঞ্চলে রিক্সা ভাড়া বেড়েছে ২০ ভাগ। আগামীকাল থেকে এই ভাড়া ১০০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। একই সাথে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বাড়তি ভাড়া আদায় করছে অটোরিকশা ও ইজিবাইক চালকরাও। সব রুটে লেগুনা ভাড়া দ্বিগুণ আদায় করা হচ্ছে।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকার ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে চালক-সহকারীর বেতন ও দুই ঈদের বোনাস যাত্রী সাধারণের কাছে থেকে আদায় করে নিলেও তাদের বেতন বোনাস না দেওয়ায় রাজধানীর বাস-মিনিবাসে ঈদের ৩ দিন আগে থেকে ঈদের ৩ দিন পর পর্যন্ত যাত্রী উঠানামায় সর্বনিম্ন ভাড়া ৫০ টাকা হারে আদায় করা হয়। এবারও এ হারে ভাড়া আদায়ের লক্ষ্যে চালক-শ্রমিক ও পরিবহন চাঁদাবাজরা মরিয়া হয়ে উঠেছে।
তিনি আরও বলেন, রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের মহোৎসব চলছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বিআরটিএ, জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালত নানাভাবে তৎপরতা চালিয়ে, কাউন্টারে কাউন্টারে জরিমানা আরোপ করেও এই ভাড়া নৈরাজ্য ঠেকাতে পারছে না। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে যাত্রাপথে বিভিন্ন বাসে যাত্রী প্রতি ১০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। নৌ পথেও ভাড়া নৈরাজ্য চরমে ঠেকেছে। রেলে টিকিট কালোবাজারি, অনলাইনে টিকিট পেতে বিড়ম্বনা অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় এবার চরমে পৌঁছেছে। আকাশ পথেও এহেন ভাড়া নৈরাজ্যের কারণে যাত্রী সাধারণ এখন দিশেহারা।
শ্রমিকদের ঈদের বেতন-বোনাস দেওয়া হয় না। সেই টাকা ওঠানোর নামে যাত্রীদের থেকে বড় অ্যামাউন্ট সিন্ডিকেট করে আদায় করা হচ্ছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, গত বছরের নভেম্বরে সরকার ডিজেলের মূল্য ২৩ ভাগ বাড়ানোর সময়ে বাস ভাড়া ২৭ ভাগ ও লঞ্চ ভাড়া ৩৬ ভাগ বাড়ানো হলেও লঞ্চ মালিকেরা নানা কারচুপির মধ্যে দিয়ে সর্বোচ্চ ৪৬ শতাংশ হারে বর্ধিত ভাড়া আদায় করে আসছিলেন। ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটে আগে ডেকের ভাড়া ছিল ২০০ টাকা। ভাড়া বৃদ্ধির পর তা ৩৫০ টাকা হারে আদায় করা হলেও এবারের ঈদে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা হারে আদায় করা হচ্ছে। এক শয্যার কেবিনের ভাড়া ৯০০ টাকা ছিল, ভাড়া বৃদ্ধির পর তা ১ হাজার ২০০ টাকা করা হলেও এবারের ঈদে ১ হাজার ৫০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। দুই শয্যার ডাবল কেবিনের ভাড়া আগে ছিল ১ হাজার ৮০০ টাকা। ভাড়া বৃদ্ধির পর তা ২ হাজার ৪০০ টাকা করা হলেও এখন আদায় করা হচ্ছে ৩ হাজার টাকা। আবার এসব টিকিটের কালোবাজারিরা আরও ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা বর্ধিত মূল্য নিয়ে যাত্রীদের হাতে তুলে দিচ্ছে।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এবারের ঈদে গণপরিবহন সংকটকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির অতিলোভী কিছু অসাধু মালিক ও পরিবহন চাঁদাবাজদের নেতৃত্বে ভাড়া নৈরাজ্যের এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। কিছু অসাধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেও এহেন ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ করতে পারছে না।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণমতে, সড়কপথে ঢাকা থেকে চুয়াডাঙ্গা, বগুড়া, রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রামসহ উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি রুটে যাত্রীপ্রতি ৩০০-৫০০ টাকা হারে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে, যা আগামীকাল থেকে দিগুণ হয়ে যাবে। ঢাকা-রংপুর রুটে হানিফ এন্টারপ্রাইজের ভাড়া আগে ১ হাজার টাকা নেওয়া হলেও এখন ১ হাজার ৮০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এ রুটে ঈগল পরিবহনের ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা নেওয়া হলেও এখন ১ হাজার ৮০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। শাহ আলী পরিবহনে ৮৫০ টাকার ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ টাকা।
ঢাকা-লালমনিরহাট রুটে শুভ বসুন্ধরায় ৮০০ টাকার ভাড়া ১ হাজার ৩০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা-পটুয়াখালী সাকুরা পরিবহনের এসি বাসে ১ হাজার টাকার ভাড়া ১ হাজার ৪০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলের পথে বিভিন্ন বাসে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আবার কিছু কিছু রুটে স্বল্প দূরত্বে যেতে চাইলেও টিকিট নেই অজুহাত দিয়ে বেশি দূরত্বের টিকিট নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। যেমন, চট্টগ্রামের কেরানীহাট বা লোহাগড়ার যাত্রীদের ১০০ কিলোমিটার বেশি দূরত্বে কক্সবাজারের টিকিট কিনতে হচ্ছে। অনুরূপ কেউ কাপ্তাই যেতে চাইলে তাকে রাঙামাটির টিকিট কিনতে হচ্ছে। কেউ রাজশাহী যেতে চাইলে তাকে নওগাঁর টিকিট কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এই নৈরাজ্যের কারণে নিম্ন আয়ের লোকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস-ট্রাক ও ট্রেনের ছাদে, কাভার্ডভ্যান, পণ্যবাহী পরিবহন ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনে কম ভাড়ায় যাতায়াত করতে বাধ্য হবেন। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়বে। এসব কারণে জরুরি ভিত্তিতে এহেন ভাড়া-নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ আবদুল হক, সংগঠনের সহসভাপতি তাহিদুল হক রিপন, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শরিফুজ্জামান শরীফ প্রমুখ।
এর আগে আসন্ন ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে যাত্রীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি। সদরঘাট নদীবন্দরসহ দেশের সবকটি নৌ-বন্দর ও লঞ্চঘাটে এবং খেয়া পারাপারের ৪ শতাধিক ঘাট পয়েন্টে বিআইডাব্লিউটিএ ও জেলা পরিষদের ইজারাদারেরা চুক্তির শর্ত লংঘন করে অতিরিক্ত টোল আদায়ের নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি করেছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সমিতির পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে এমন অতিরিক্ত টোল আদায়ের বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সদরঘাটে নদীতে নামতে-উঠতে যাত্রীপ্রতি টোল নেওয়া হচ্ছে। অথচ সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী খেয়া পারাপারে যাত্রীপ্রতি ভাড়া আদায়ের কথা বলা আছে। এখানে কেউ পরিবারের জন্য বাজার-সদাই নিয়ে পারাপার হলে তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক ২০/৩০/৫০/১০০ টাকা হারে অবৈধভাবে চাঁদা নিচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ নিয়োজিত ইজারাদার। যদিও এই ঘাটে ইজারাদারের নৌকায় পারাপারের ক্ষেত্রে যাত্রীপ্রতি ভাড়া আদায়ের চুক্তি রয়েছে।’
জানা গেছে, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও চাঁদাবাজি রোধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরও অপরাধ, চাঁদাবাজি রোধে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া মহাসড়কে পণ্যবাহী গাড়ি না থামাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মাঠপর্যায়ের পুলিশকে। সারা দেশে পণ্য পরিবহনের ওপর নজরদারি করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও গোয়েন্দারা। অভিযোগ রয়েছে, পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজিতে পরিবহন মালিক, শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও রয়েছেন। তাদের কাছ থেকে মাসোহারা নেন অসাধু পুলিশ সদস্যরাও। এ ছাড়া স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদা আদায় করা হয়ে থাকে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চাঁদাবাজি রোধে পুলিশ সদর দফতরকে নির্দেশনা দিয়েছে। এরপর পুলিশ সদর দফতর সারা দেশের মাঠপর্যায়ের পুলিশকে নির্দেশনা দিয়েছে চাঁদাবাজি বন্ধের। পুলিশ সদর দফতর গণমাধ্যমকে জানিয়েছে- পবিত্র রমজান ও আসন্ন ঈদকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজি রোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ বা তথ্য ছাড়া মহাসড়ক অথবা সড়কে চলাচলকারী পণ্যবাহী কোনো গাড়ি থামানো যাবে না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, এক সময়ের চাঁদাবাজরা এখন টোলের নামে চাঁদাবাজি করছে। শুধু টার্মিনাল থেকে বের হওয়া এবং বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত বাস-মিনিবাস থেকে টোল আদায় করার বিধান থাকলেও বেপরোয়াভাবে তারা এখন টোল আদায় করছে। এমনকি চলতি গাড়ি থামিয়েও টোলের নামে চাঁদাবাজি করে থাকে। এবিষয়ে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৫
আপনার মতামত জানানঃ