গত মঙ্গলবার দুপুরে জোরালো বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। আত্মঘাতী বোমা হামলায় একটি গাড়িতে থাকা তিন চীনা নাগরিক-সহ চার জন নিহত হন। হামলার দায় স্বীকার করে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)।
বিএলএ এক বিবৃতিতে জানায়, আত্মঘাতী হামলা চালানোর জন্য মানববোমা হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছিল শারি বালোচ ওরফে ব্রামশকে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, বোরখা পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের মুখে দাঁড়িয়ে এক নারী। চীনা নাগরিকদের নিয়ে সাদা রঙের একটি ভ্যান বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে যাওয়ার মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটে।
আত্মঘাতী সেই বোমা হামলার ঘটনাটি ধরা পড়েছে সিসি ক্যামেরায়।
সিসি ক্যামেরায় দেখা যায় বোরকা পরিহিতা এক নারী খুব স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। যেই না চীনের নাগরিকদের বহনকারী গাড়িটি তার সামনে এসেছে তিনি তখনই নিজেকে উড়িয়ে দেন।
এবার সেই নারীর পরিচয় খুঁজে বের করেছে পাকিস্তানের গণমাধ্যম জিও নিউজ। তারা জানিয়েছে বোমা হামলা ঘটান উচ্চ শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক নারী।
৩০ বছর বয়সী শারি দুই সন্তানের মা। আত্মঘাতী হামলার দশ ঘণ্টা আগে নিজের টুইটার হ্যান্ডলে লিখেছিলেন, ‘গুড বাই’।
বেলুচিস্তানের তুরবাতের নিয়াজার আবাদের বাসিন্দা শারি প্রাণীবিদ্যায় স্নাতকোত্তর করেছেন বেলুচিস্তান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এমফিল করেছেন আলামা ইকবাল মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
২০১৪ সালে বিএড করেন শারি। ২০১৮-য় এমএড। বালুচিস্তানের কেচ জেলায় একটি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করছিলেন। শারি বিয়ে করেছিলেন এক দন্ত চিকিৎসককে। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে। এক জনের বয়স আট, অন্য জনের পাঁচ।
শারির বাবা একটি সরকারি সংস্থার কর্মকর্তা ছিলেন। তিন বছর জেলা পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন শারির বাবা। শারির দেওর কলেজের অধ্যাপক। তার কাকা এক জন লেখক, অধ্যাপক এবং মানবাধিকার কর্মী। শারির বাপের বাড়ি এবং শ্বশুরবাড়ি দুই কুলই উচ্চশিক্ষিত।
ছাত্রাবস্থায় বালোচ স্টুডেন্টস’ অর্গানাইজেশন-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শারি। বছর দুয়েক আগে সংগঠনের আত্মঘাতী স্কোয়াড মজিদ ব্রিগেডে যোগ দিয়েছিলেন।
শারির দুই সন্তানের কথা ভেবে তাকে অন্য কোনও স্কোয়াড বেছে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বিএলএ-র তরফে। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। বরং আত্মঘাতী স্কোয়াডেই যে তিনি যোগ দিতে চান, সে কথা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে জানিয়েছিলেন।
বিএলএ-র আত্মঘাতী স্কোয়াড মজিদ ব্রিগেডের নিয়ম অনুযায়ী শারিকে তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্য সময় দেওয়া হয়েছিল।
ফলে গত দু’বছর ধরে মজিদ ব্রিগেডের বিভিন্ন শাখার সঙ্গে কাজ করেন শারি। এই সময়ের মধ্যে আত্মঘাতী হামলা চালানোর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন।
মাস ছয়েক আগে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে শারি জানান, আত্মঘাতী হামলার জন্য তিনি পুরোপুরি প্রস্তুত। তার পরই তাকে সরাসরি আত্মঘাতী স্কোয়াডের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা পর বিএলএ এক বিবৃতি জারি করে জানায়, ‘মজিদ ব্রিগেডের ফিদায়েঁ শারি বালোচ ওরফে ব্রামশ তার দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেছেন।’
বিএলএ মুখপাত্র জিয়ান্দ বালোচ বলেন, ‘বালুচিস্তানে চীনের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কোনও উপস্থিতিই সহ্য করব না আমরা। বালুচিস্তান থেকে দূরে থাকার জন্য বার বার সতর্ক হয়েছিল চীনকে’।
জীববিদ্যায় স্নাতোকত্তর, পেশায় স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষিকা ওই মহিলার আচমকাই জঙ্গি কার্যকলাপের দিকে পা বাড়ানো এবং তার এই আত্মত্যাগ অবাক করছে তদন্তকারীদেরও।
এর পরই জিয়ান্দ হুঁশিয়ারি দেন, পাকিস্তানের সেনাকে বালুচিস্তানে গণহত্যা চালানোয় মদত জোগাচ্ছে চীন। শুধু তাই নয়, চীন বালুচিস্তানে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। তাদের এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে কোনও ভাবেই বরদাস্ত করবে না বিএলএ।
পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিস্ফোরণের ঘটনায় মানববোমা শারি বালোচের পরিচয় দেখে তাজ্জব বনে গিয়েছে গোটা বিশ্ব। জীববিদ্যায় স্নাতোকত্তর, পেশায় স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষিকা ওই মহিলার আচমকাই জঙ্গি কার্যকলাপের দিকে পা বাড়ানো এবং তার এই আত্মত্যাগ অবাক করছে তদন্তকারীদেরও।
জানা গিয়েছে, তার বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মচারি। স্বামী হাবিতান বাশির বালোচ পেশায় দন্ত চিকিৎসক। দুই সন্তানের মা শারি কেন আচমকা এহেন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন, তা নিয়ে সকলেই হতভম্ব।
৩০ বছরের শিক্ষিকা শারি বালোচের সঙ্গে এই ধরণের সন্ত্রাসবাদী অর্গানাইজেশনের কোনো যোগাযোগ ছিল না। এই প্রথম কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল সে। তবে স্ত্রীর এই আত্মত্যাগকে মহান হিসেবেই স্বীকৃতি দিচ্ছেন স্বামী হাবিতান বশির বালোচ।
একটি অজ্ঞাতপরিচয় টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে স্ত্রীকে স্মরণ করে হাবিতান বশির লেখেন, ‘আমার স্ত্রীর জন্য আমি গর্বিত। শারি জান, তোমার এই আত্মত্যাগে আমি বাকরুদ্ধ। আমাদের দুই সন্তান মাহরোচ এবং মীর হাসান বড় হয়ে একদিন তোমার জন্য গর্ব অনুভব করবে। সকলেই একদিন উপলব্ধি করতে পারবে, তুমি কত মহান। তুমি আজীবন আমাদের স্মরণে এভাবেই থাকবে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে সক্রিয় ছিলেন শারি বালোচ। টুইটারে করা পোস্ট থেকে তার মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
২৪ এপ্রিল এক টুইটে শারি বালোচ লেখেন, ‘আমার ভূমি আমাকে দুটি বিষয় শিখিয়েছে—ভালোবাসা ও প্রতিরোধ।’
জামাল বালোচের একটি পোস্ট ২ মার্চ রিটুইট করেন শারি বালোচ। এতে লেখা ছিল, ‘প্রতিরোধই আমাদের সংস্কৃতি, তা উদ্যাপন করতে চাইলে প্রতিরোধ করুন।’
গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর শারি বালোচ বিজয়চিহ্নের একটি ছবি পোস্ট করেন। ছবির ক্যাপশনে তিনি লেখেন, ‘আমি এমন একটি গল্প নই, যা চিরকাল থাকবে। আমি আমার দায়িত্ব পালন করব এবং বিদায় নেব।’
একই মাসে আগেও অন্তত দুবার একই পোস্ট দিয়েছিলেন শারি বালোচ।
গত ১৩ ডিসেম্বর বিজয়চিহ্ন পোস্ট করে শারি বালোচ লেখেন, ‘একটি ভালো আগামীর জন্য বলিদান…।’
গত ৮ ডিসেম্বর মার্কিন সাহিত্যিক উরসুল কে লে গুইনের একটি উদ্ধৃতি পোস্ট করেন শারি বালোচ। এতে লেখা ছিল ‘তুমি বিপ্লব কিনতে পারবে না। তুমি বিপ্লব তৈরি করতে পারবে না। তুমিই কেবল বিপ্লব হয়ে উঠতে পারো। এটি তোমার আত্মায় আছে, অথবা তা কোথাও নেই।’
উচ্চশিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত পরিবারের সন্তান শারি বালোচ। বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে অতীতে এই পরিবারের কোনো সদস্যের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
ঠিক কোন বিষয়টি শারি বালোচকে বিচ্ছিন্নতাবাদে যুক্ত হতে প্ররোচিত করেছে, তা বলা মুশকিল। অবশ্য শিক্ষাজীবনে তিনি বেলুচ ছাত্রসংগঠনের (বিএসও-আজাদ) সদস্য ছিলেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শারি বালোচের পরিবারের কোনো সদস্য নিখোঁজ বা গুমের শিকার হননি। অবশ্য ২০১৮ সালে কেচ জেলায় এক সামরিক অভিযানে তাঁর দূরসম্পর্কের এক কাজিন নিহত হন।
শারি বালোচের টুইটগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি প্রচুর পড়াশোনা করতেন। টুইটে তিনি চে গুয়েভারা, জ্যঁ জ্যাক রুশোর মতো ব্যক্তিদের উদ্ধৃতি ব্যবহার করতেন।
এ ছাড়া দান্তে আলিগিয়েরি, মার্ক টোয়েন, রবার্ট আ হাইনলাইন, পাওলো কোয়েলহোর মতো ক্ল্যাসিক ও আধুনিক লেখকদের উদ্ধৃতিও ব্যবহার করতেন শারি বালোচ।
গত ৩০ ডিসেম্বর এক টুইটে শারি বালোচ লেখেন, ‘বই ছাড়া একটি কক্ষ আত্মাহীন শরীরের মতো।’
দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে বলা হয়, আত্মঘাতী হামলায় একজন নারীকে কাজে লাগানোর কৌশল কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ প্রশ্নগুলো হলো—বেলুচ বিদ্রোহ কি নিজেকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে? এ ধরনের হামলায় এখন কেন নারীকে ব্যবহার করা হলো? আগে কেন করা হয়নি? এই নারীদের কি মগজধোলাই করা হয়েছে? নাকি জোর করা হয়েছে?
মঙ্গলবার দুপুরে পাকিস্তানের বৃহত্তম শহর ও দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ সিন্ধুর রাজধানী করাচির প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় করাচি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে একটি মাইক্রোবাসে বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, গাড়িটির ডানপাশে বিস্ফোরণ হয়েছে।
ফুটেজ আরও দেখা যায়, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স ফ্যাকাল্টি নিকটবর্তী কনফুসিয়াস সেন্টারের দিকে যখন মাইক্রোবাসটি আসছিল, সেই সময় ওই ভবনের গেটের কাছে অবস্থান নেন এক নারী। মাইক্রোবাসটি তার মধ্যকার দূরত্ব যখন প্রায় এক মিটার, সেই সময়ই নিজ দেহে বহন করা বোমার বিস্ফোরণ ঘটান তিনি।
গাড়িটিতে সেই সময় চারজন চীনের নাগরিক ও দুজন পাকিস্তানি ছিল। হামলার পর ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিন চীনা নাগরিক হুয়াং গুইপিং, ডিং মুপেং, চেন সা ও সেই মাইক্রোবাসের ড্রাইভার খালিদ। বাকি দুজনকে আহতাবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়।
হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অপর চীনা নাগরিক ওয়াং ইউকিং মারা গেছেন বলে নিশ্চিত করেছে করাচি পুলিশ।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এ ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে নিন্দা জানিয়েছেন। এক বার্তায় তিনি বলেন, ‘আমি এ নৃশংস, ঘৃণ্য ও কাপুরুষোচিত হামলার কঠোর নিন্দা জানাচ্ছি। যারাই এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকুক, অবশ্যই তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫৮
আপনার মতামত জানানঃ