ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের পণ্যবাজারে অর্ধ শতকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধাক্কা লাগতে যাচ্ছে বলে সতর্ক করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ পূর্বাভাস দেওয়া হয়।
ইউক্রেনে রুশ হামলার জেরে চলমান যুদ্ধের ‘গুরুতর প্রভাব’ পড়বে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে—এমন সতর্কবার্তা দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফও।
আইএমএফ বলছে, ইউক্রেন ও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকা দেশগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া ইউক্রেন ছেড়ে লোকজন শরণার্থী হিসেবে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়ার প্রভাবও বৈশ্বিক অর্থনীতি পড়বে বলে মনে করছে সংস্থাটি।
ইউক্রেনে যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, খাদ্য পণ্যের দাম বাড়তি থাকার সময়সীমাও তত বাড়তে থাকবে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব ব্যাংক।
কী বলছে বিশ্বব্যাংক
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের কারণে গ্যাস থেকে গম ও তুলা পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্যে দাম অনেক বেড়ে গিয়েছে এবং এই ধাক্কা ১৯৭০ এর দশকের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।
জ্বালানির দাম ৫০ শতাংশের বেশি বাড়ার দিকে এগোচ্ছে, যা ব্যবসা ও সংসার চালানোর খরচ অনেক বাড়িয়ে দেবে।
বিশ্ব ব্যাংকের এ প্রতিবেদনের সহ-লেখক পিটার ন্যাগল বিবিসিকে বলেন, পণ্যের দামের এই ঊর্ধ্বগতি এরইমধ্যে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও মানবিক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। বিশ্বজুড়ে মানুষকে জীবনযাত্রার বাড়তি খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
জ্যেষ্ঠ এ অর্থনীতিবিদ বলেন, আমরা গরীব পরিবারগুলোর জন্য বেশি উদ্বিগ্ন, যেহেতু তাদের আয়ের সিংহভাগ খাবার ও জ্বালানির পেছনে খরচ হয়। পণ্যের দাম বাড়লে তারাই সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে পড়ে।
বিশ্ব ব্যাংক বলছে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত বিশ্ব টানা ২৩ মাস জ্বালানির দামে ঊর্ধ্বগতি দেখছে। মধ্যপ্রাচ্য সংকটের জেরে ১৯৭৩ সালের জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধির পর এটাই দীর্ঘতম সময় ধরে জ্বালানির দাম বেড়ে চলার ঘটনা।
একইভাবে জ্বালানি তেলের দামও ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাড়তি থাকবে এবং চলতি বছরজুড়ে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম গড়ে ১০০ ডলারে বিক্রি হবে, যা বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে ভূমিকা রাখবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।
সবচেয়ে বেশি বাড়বে ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম, যা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যেতে পারে বলে বিশ্ব ব্যাংকের ধারণা। আগামী বছরের শরৎ এবং ২০২৪ সালের পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় ২০২৪ সালে গ্যাসের দাম ১৫ শতাংশ বেশি থাকবে।
রাশিয়া বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাহিদার ৪০ শতাংশ গ্যাস ও ২৭ শতাংশ তেল সরবরাহ করে। কিন্তু ইইউ রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছে, যা বিশ্বজুড়ে তেল-গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। মূলত চাহিদা ও সরবরাহ ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে।
বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাসে সতর্ক করা হয়েছে, অনেক খাদ্য পণ্যের দাম হঠাৎ লাফিয়ে বাড়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য মূল্য সূচক এরইমধ্যে ইতিহাসের সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। ছয় দশক আগে এই সূচক চালু করা হয়।
গমের দাম ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়তে পারে এবং ডলারের হিসাবে এটা দাম বৃদ্ধির নতুন রেকর্ড গড়ার পথে আছে। অন্যান্য খাদ্য পণ্যের মধ্যে বার্লি ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ, সয়াবিন ২০ শতাংশ, ভোজ্য তেল ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ ও মুরগির দাম ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়তে পারে।
এসব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি এটাই ইঙ্গিত করছে যে, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে এসব পণ্যের রপ্তানি রাতারাতি কমে গেছে।
সার, বিভিন্ন ধাতু ও খনিজ দ্রব্যের মত কাঁচামালের দামও বাড়তে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে বিশ্ব ব্যাকের পূর্বাভাসে। তবে কাঠ, চা ও চালের মত কয়েকটি পণ্যের দাম কমবে বলে আশা করা হয়েছে সেখানে।
ঝুঁকিতে বৈশ্বিক কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থা
করোনাভাইরাস মহামারী-উত্তর মুদ্রাস্ফীতি, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা ও জাহাজীকরণ ব্যয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে অস্থির পণ্যবাজারকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলেছে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন। বিশেষ করে শস্য, জ্বালানি ও খামার খাতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সম্প্রতি খাদ্য ও কৃষি খাতের ওপর যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে ডাচ ব্যাংকিং ও আর্থিক কোম্পানি রাবোব্যাংকের বিশ্লেষকরা এমনটা জানান।
রাবোব্যাংকের বৈশ্বিক শস্য ও অয়েলসিডবিষয়ক কৌশলবিদ স্টিফেন নিকোলসন বলেন, শস্য ও অয়েলসিডের দাম এরই মধ্যে বৃদ্ধির দিকে, আগামী দিনগুলোয় এটি আরো বাড়বে। এমন সময়ই যুদ্ধের মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো বিশ্ব। এ পরিস্থিতি জ্বালানি তেলের বাজারকেও সর্বোচ্চ অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে সবচেয়ে আশঙ্কা বেশি গম নিয়ে। কারণ রাশিয়া ও ইউক্রেন সম্মিলিতভাবে বৈশ্বিক রপ্তানি পরিমাণে ২৯ শতাংশ গম সরবরাহ করে। পাঁচ বছরের ভিত্তি অনুসারে এমনটা দেখা গেছে। আমরা কোথা থেকে বাড়তি গমের সরবরাহ পাব। রাশিয়া ও ইউক্রেন খুব বেশি পরিমাণ মজুদ করে না। তারা হয়তো এগুলো অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত অথবা রপ্তানি করে।
রাবোব্যাংকের এ কৌশলবিদ বলেন, যদি আপনি বিশ্বের অন্য রপ্তানিকারকদের ওপর ভরসা করেন, তাহলে দেখবেন তারাও খুব বেশি পরিমাণ মজুদ করে না, যা দিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে রপ্তানি বন্ধ হলে সেটির ঘাটতি সামাল দেয়া যাবে। এ কারণে আন্তর্জাতিক গমের বাজার দ্রুতই অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে।
চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়া রেকর্ড পরিমাণ শস্য উৎপাদন করেছে। ফলে এ সময়ে গম রপ্তানিতে একটি প্রবৃদ্ধি দেখা যাবে। চলতি বছর একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গম, ভুট্টা ও যব এরই মধ্যে জাহাজীকরণ করেছে রাশিয়া ও ইউক্রেন। এতে সারা বছরের জন্য দেশ দুটি থেকে রপ্তানি বন্ধ হওয়ার ঘাটতি অন্যদের বহন করতে হবে না।
স্টিফেন নিকোলসন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি শুধু পণ্যের দামকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলবে, যা এরই মধ্যে বাজারে চলমান। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে ক্রেতারা ভাবতে শুরু করবে তারা কোথায় ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে।
এরই মধ্যে মার্কিন বহুজাতিক খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও পণ্য ব্যবসায়িক করপোরেশন আর্চার ড্যানিয়েলস মিডল্যান্ড কোম্পানি (এডিএম) অঞ্চলটিতে (রুশ-ইউক্রেন অঞ্চল) তাদের বেশকিছু কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেছে। ক্রেতারা চিন্তা করতে শুরু করবে তারা কি তাদের সরবরাহ ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলতে চায় কিনা।
বৈশ্বিক সূর্যমুখী তেলের ৭৮ শতাংশ সরবরাহ করে রাশিয়া। এসবের অধিকাংশের ক্রেতা এশিয়ার দেশগুলো। ফলে বর্তমানে এসব ক্রেতাকে বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে। নিকোলসন বলেন, এটা একটি কঠিন সমস্যা। আমরা দেখতে পাচ্ছি বায়োডিজেল ও নবায়নযোগ্য ডিজেলের চাহিদা বাড়ায় বিশ্বব্যাপী ভোজ্যতেলের সরবরাহ সংকট প্রকট।
এটি পাম অয়েলের ওপরও চাপ সৃষ্টি করবে। এসময় পাম অয়েলের উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো চিত্রও আমরা দেখতে পাচ্ছি না। বেশ কয়েক বছর ধরে বর্তমান গাছগুলো বেশ পুরনো হয়ে গিয়েছে এবং নতুন কোনো রোপণের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।
বৈশ্বিক পটাশের ৪০ শতাংশ রপ্তানি করে রাশিয়া ও বেলারুশ। অ্যামোনিয়ার বৈশ্বিক রপ্তানি পরিমাণের ২২ শতাংশ করে রাশিয়া। দেশটি বৈশ্বিক রপ্তানি পরিমাণে ১৪ শতাংশ ইউরিয়া এবং ১৪ শতাংশ মনো-অ্যামোনিয়াম ফসফেটও রপ্তানি করে।
এসব পণ্যের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করাটা ক্রেতাদের জন্য খুব সহজ নয় বলে জানান টেইলর। অ্যামোনিয়া রাশিয়া থেকে কৃষ্ণ সাগরীয় পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়, যা বর্তমানে বন্ধ। এটি বাজারকে একটি বড় ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
রাশিয়ার সামরিক অভিযানের আগে থেকেই প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ অস্থির সময় পার করছিল। এ ঘটনার ফলে দাম আরো বাড়তে শুরু করে। জ্বালানি তেলের মানদণ্ডে প্রতি ব্যারেল সমপরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ২০০ ডলারের বেশি দাঁড়িয়েছে।
রাবোব্যাংকের জ্বালানি পণ্যবিষয়ক কৌশলবিদ রায়ান ফিটজমারিস বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের দামে সবচেয়ে বেশি প্রভাব দেখা যাচ্ছে ইউরোপীয় অঞ্চলে। এশিয়া ও ইউরোপে ব্যবহূত অধিকাংশ গ্যাস সরবরাহ করে রাশিয়া। এতে ইউরোপ সবচেয়ে বেশি সরবরাহ সংকটের এবং যুক্তরাষ্ট্র তার পাম্প ও আবাসিক ভবনের গ্যাস সরবরাহের ঝুঁকিতে আছে। রাশিয়া ইউরোপের তেল আমদানির ৩০ শতাংশ ও প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির ৩৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
পাশাপাশি বৈশ্বিক অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ১০ শতাংশ সরবরাহ করে রাশিয়া, যার পরিমাণ এক কোটি ব্যারেল। একই সঙ্গে দেশটি ডিজেল ও গ্যাসোলাইনেরও উল্লেখযোগ্য রপ্তানিকারক।
ভেঙে পড়ছে সরবরাহ ব্যবস্থা
সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশ ইউক্রেনের স্থল, আকাশ ও সমুদ্রসীমায় রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের ফলে হুমকিতে পড়েছে বিভিন্ন পণ্যের সরবরাহ চেইন। বিশেষ করে শস্য ও তেলবীজের সরবরাহ চেইন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।
বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে এসব পণ্যের উল্লেখযোগ্য অংশের জোগান দিয়ে থাকে দেশ দুটি। পাশাপাশি রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার ফলে জ্বালানি ও ধাতব পণ্য রপ্তানিতেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে। খবর রয়টার্স ও সিএনবিসি।
বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের মোট ২৯ শতাংশ গমের সরবরাহ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। যার বেশির ভাগই রপ্তানি করা হয় কৃষ্ণ সাগরের বন্দর ব্যবহার করে। আর এসব গমের উল্লেখযোগ্য ক্রেতা তুরস্ক, মিসরসহ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো।
পাশাপাশি বিশ্বের শীর্ষ ভুট্টা রফতারিকারকের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে ইউক্রেন। দেশটি প্রতি মাসে ৪৫ লাখ টন ভুট্টা রপ্তানি করে, যার বেশির ভাগের ক্রেতা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীন। অন্যদিকে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে সরবরাহকৃত সানফ্লাওয়ার তেলের ৮০ শতাংশের জোগান দেয় রাশিয়া ও ইউক্রেন।
বিশ্লেষকরা জানান, ইউক্রেনকে সাধারণত ইউরোপের রুটির ঝুড়ি হিসেবে গণ্য করা হয়। আগ্রাসনের প্রভাবে এরই মধ্যে গম ও ভুট্টার দাম বাড়াতে শুরু করেছে।
চলতি বছরের শুরুর তুলনায় শিকাগোয় গমের ভবিষ্যৎ সরবরাহ মূল্য বেড়েছে ১২ শতাংশের মতো। একই সময়ে ভুট্টার ভবিষ্যৎ সরবরাহ মূল্য বেড়েছে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে খাদ্যপণ্যের দাম আরো বাড়তে শুরু করবে।
সোর্সিং টেকনোলজি কোম্পানির সিইও অ্যালেন হল্যান্ড বলেন, যুদ্ধের ফলে খাদ্য সরবরাহ চেইন সবচেয়ে বড় হুমকির সম্মুখীন হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ