তুরস্কের অধিকারকর্মী ও সমাজসেবী ওসমান কাভালাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে দেশটির একটি আদালত। তার বিরুদ্ধে রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান নেতৃত্বাধীন সরকার উৎখাতের চেষ্টার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিন বিচারকের প্যানেল সোমবার(২৫ এপ্রিল) সরকার পতনের প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করার অভিযোগে আরও ৭ ব্যক্তিকে ১৮ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে।
২০১৩ সালে গেজি পার্কে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে জড়িত থাকা এবং ২০১৬ সালে দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টায় ভূমিকা রাখার অভিযোগে কাভালাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
২০১৭ সাল থেকে বিনা বিচারে কারাগারে ছিলেন কাভালা। ২০১৩ ও ২০১৬ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারকে উৎখাতের চেষ্টার সঙ্গে জড়িত থাকার মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন তিনি। তবে নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাভালা। রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে এই রায় দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে পশ্চিমা বিশ্ব।
এ রায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমা কূটনীতিকেরাও।
২০১৩ সালে তুরস্কে শুরু হওয়া সরকার বিরোধী বিক্ষোভের আয়োজন এবং অর্থায়নের জন্য প্রথম অভিযুক্ত করা হয়েছিল কাভালাকে। ওই মামলায় তাকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে অভিযুক্ত হওয়ার পরপরই তাকে আবার অভিযুক্ত করা হয়। এবার ওই দুই মামলাতেই তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।
ইস্তাম্বুলের একটি উচ্চ নিরাপত্তাসম্পন্ন কারাগার থেকে দেয়া ভিডিও বার্তায় কাভালা আদালতকে বলেছেন, পুরো প্রক্রিয়াকে তিনি বিচারিক হত্যা হিসেবে দেখছেন।
আদালতের রায় ঘোষণার আগে কাভালা বলেন, এগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় তৈরি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।
কাভালার বিরুদ্ধে করা মামলা এখন সুপ্রিম কোর্টে যাবে, যেখানে আপিলের সুযোগ পাবেন।
ইউরোপের সর্বোচ্চ আদালত ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটস বলেছে, কাভালার অপরাধের পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই। তাকে দমানোর জন্য গ্রেপ্তার করা হয়।
কাভালার অপরাধের পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই। তাকে দমানোর জন্য গ্রেপ্তার করা হয়।
কাভালা প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন এবং যুক্তরাজ্যে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র পরিচালনা করতেন। রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে। তুরস্ক সরকার কাভালাকে মার্কিন বিলিয়নিয়ার জর্জ সোরোসের এজেন্ট হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন।
এর আগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ইউরোপের মানবাধিকার আদালত তাকে মুক্তি দিতে নির্দেশ দেয়। সে সময় মানবাধিকার আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, তুরস্ক কাভালার মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে এবং তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান অবশ্য ভিন্ন কথা বলেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, ‘কাভালা হচ্ছেন হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়নেয়ার জর্জ সোরসের এজেন্ট, যিনি বিদেশি অর্থের সাহায্যে তুরস্কের পতন ঘটাতে চেয়েছিলেন। আমরা কাভালার মতো মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে পারি না।’
২০১৪ সালের আগস্টে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এরদোয়ান। এর আগে ১১ বছর তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে এরদোয়ানকে অবমাননা করায় কয়েক হাজার মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। রয়টার্সের খবর বলছে, গত বছর এ ধরনের ৩১ হাজারের বেশি অভিযোগের তদন্তকাজ চলেছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে সক্রিয় আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের তালিকা অনুযায়ী, স্বাধীন গণমাধ্যম সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে তুরস্কের অবস্থান ১৫৩তম।
তুরস্কে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের ওপর কড়া নজর রাখা হয়। এরদোয়ান বা তার মন্ত্রীদের অপমান করার দায়ে অথবা বিদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ এবং করোনাভাইরাস মোকাবিলার সমালোচনা করায় অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
গত এক দশকে তুরস্কের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের অধিকাংশই সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। ফলে সমালোচকদের মন্তব্য করার এবং নিরপেক্ষ সংবাদ তুলে ধরার জন্য জায়গা করে দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।
কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে তুরস্কের সংসদ একটি আইন পাশ করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এই আইন বাকস্বাধীনতার প্রতি বড় হুমকি।
এই আইনের আওতায় সামাজিক মাধ্যমের যেসব প্ল্যাটফর্মের দশ লাখের বেশি অনুসারী আছে, তাদের তুরস্কে স্থানীয় কার্যালয় থাকতে হবে এবং সরকার কোন কন্টেন্ট সরাতে বললে তাদের সেটা মানতে হবে।
কোন সংস্থা এই নির্দেশ অমান্য করলে তাদের জরিমানা করা হবে এবং তাদের ডেটা সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর এর প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ তাদের ডেটা সরবরাহের গতি ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়া হবে।
এই পরিবর্তন প্রযোজ্য হবে ফেসবুক, গুগল, টিকটক এবং টুইটারের মত বিশাল প্রযুক্তি সংস্থাগুলোসহ বিভিন্ন কোম্পানি এবং সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মের ক্ষেত্রে।
নতুন ইন্টারনেট আইনের ফলে পুলিশের সাথে সরকারের একযোগে কাজ করার ক্ষমতা বেড়ে যাবে এবং তারা অনলাইনে সেন্সরশিপ চালাতে পারবে। এর ফলে যারা ভিন্নমত প্রকাশ করার কারণে ইতোমধ্যেই সরকারের বিরাগভাজন হয়েছে এবং সরকার যাদের নির্দয়ভাবে লক্ষ্যবস্তু করেছে তাদের ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ