হেপাটাইটিসের রহস্যময় একটি প্রজাতি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের অন্তত ১২টি দেশে। এতে এক শিশু মারা গেছে, আক্রান্ত হয়েছে অন্তত ১৬৯ জন।
আক্রান্তদের রক্তে প্রচলিত হেপাটাইটিসের জীবাণু না মেলায় বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বাড়ছে। রহস্যময় এই ভাইরাসে আক্রান্ত এক শিশুর মৃত্যুও ঘটেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জানিয়েছে, সম্প্রতি শিশুদের মধ্যে অ্যাকিউট হেপাটাইটিস সংক্রমণের ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যার উৎস, অর্থাৎ সংক্রমণ কী থেকে হচ্ছে তা এখনও অজানা।
এখন পর্যন্ত ১২টি দেশ থেকে ১৬৯ টি সংক্রমণের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে।
কোন কোন দেশে ছড়িয়েছে?
হু-এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ছোট বাচ্চাদের মধ্যে অজ্ঞাত উৎস থেকে গুরুতর হেপাটাইটিস ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। হেপাটাইটিস সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে নাকি এ সম্পর্কে সচেতনতা, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
প্রাথমিকভাবে অ্যাডেনোভাইরাসকে এ সংক্রমণের জন্য দায়ী মনে করা হচ্ছে। তবে এর সঠিক কারণ জানতে তদন্ত চলছে।
যুক্তরাজ্যে প্রথম রহস্যময় এই ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া যায় গত জানুয়ারিতে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, গত ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ১৬৯ জনের শরীরে রহস্যময় হেপাটাইটিস শনাক্ত হয়েছে। এটি পাওয়া গেছে ইউরোপ অঞ্চলের ১১টি ও আমেরিকা অঞ্চলের একটি দেশে। সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে যুক্তরাজ্যে (১১৪ জন)।
এছাড়া স্পেনে ১৩, ইসরায়েলে ১২, যুক্তরাষ্ট্রে নয়, ডেনমার্কে ছয়, আয়ারল্যান্ডে পাঁচ, নেদারল্যান্ডসে চার, ইতালিতে চার, নরওয়েতে দুই, ফ্রান্সে দুই, রোমানিয়ায় এক ও বেলজিয়ামে একজন আক্রান্ত হয়েছে।
আক্রান্তদের বয়স এক মাস থেকে ১৬ বছর। এদের মধ্যে এক শিশু মারা গেছে ও ১৭ জনের লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশনের প্রয়োজন পড়েছে।
এখনও পর্যন্ত যে ১৬৯টি সংক্রমণের ঘটনা জানা গিয়েছে, তার মধ্যে ১১৪টি ঘটনাই ব্রিটেনের। এমন ঘটনায় বেশ চিন্তায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃপক্ষ।
কী ধরনের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে?
অতীতে শিশুদের ‘মৃদু হেপাটাইটিসে’ আক্রান্তের ঘটনা খুব বেশি শোনা না গেলেও সুস্থ শিশুদের মধ্যে ‘গুরুতর হেপাটাইটিস’ বিরলই ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে রোগ সৃষ্টিকারী এজেন্টও শনাক্ত করা যায়নি। তবে অ্যাডেনোভাইরাসকে সম্ভাব্য এজেন্ট হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে। রোগ সৃষ্টিকারী এজেন্ট শনাক্তে তদন্ত চলমান রয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের রোগ প্রতিরোধ সংস্থা ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (ইসিডিসি) ও ডব্লিউএইচও কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাধারণত জন্ডিস বা হেপাটাইটিস হলে রোগীর গায়ে জ্বর থাকলেও নতুন এই হেপাটাইটিসে আক্রান্ত শিশুদের অধিকাংশই এই উপসর্গ বোধ করেনি।
রোগীদের মধ্যে গুরুতর হেপাটাইটিস বা লিভারে প্রদাহের উপসর্গ দেখা গেছে। এতে লিভারের এনজাইম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।
অনেক ক্ষেত্রে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল উপসর্গও দেখা গেছে, যার মধ্যে পেটেব্যথা, ডায়রিয়া এবং গুরুতর হেপাটাইটিসের আগে বমি হওয়া, লিভারের এনজাইম বেড়ে যাওয়া, জন্ডিস উল্লেখযোগ্য।
বেশিরভাগ রোগীর শরীরে জ্বর ছিল না। সাধারণ ভাইরাস যেগুলো গুরুতর ভাইরাল হেপাটাইটিস সৃষ্টি করে (হেপাটাইটিস ভাইরাস এ, বি, সি, ডি এবং ই), এক্ষেত্রে সেগুলোর কোনোটিই শনাক্ত হয়নি।
এর সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ বা অন্য দেশের ঘটনাগুলোর মধ্যে যোগসূত্রও এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।
হু দাবি করছে এখন পর্যন্ত ৭৪টি সংক্রমণের ক্ষেত্রে কমন কোল্ড ভাইরাস বা অ্যাডিনোভাইরাসের খোঁজ মিলেছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে কোভিড সংক্রমণের প্রমাণ মিলেছে।
আবার ১৯টি এমন প্রমাণ মিলেছে যেখানে করোনা এবং অ্যাডিনোভাইরাস দুটি সংক্রমণই পাওয়া গিয়েছে। এর সঙ্গে কি লিভারে প্রদাহের কোনও যোগ রয়েছে?
বিষয়টি বুঝতে সদস্য দেশগুলির সঙ্গে মিলে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ইসিডিসির কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘আক্রান্ত শিশুদের নমুনা বিশ্লেষণ করে প্রচলিত কোনো হেপাটাইটিস ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। করোনা টিকা নেওয়া কিংবা খাদ্য, পানীয় অথবা ব্যক্তিগত কোনো অভ্যাসের কারণে এই রোগ হয়েছে—এমন প্রমাণও আমরা পাইনি।’
‘ঠিক কী কারণে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে, তা এখনও আমাদের কাছে অস্পষ্ট। তবে ইসিডিসি ইতোমধ্যে এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে, যেসব দেশে এই হেপাটাইটিস দেখা দিয়েছে, তারাও পৃথকভাবে বিষয়টির অনুসন্ধান করছে।’
বার্সেলোনার হেপাটোলজি অধ্যাপক এবং ইউরোপিয়ান এসোসিয়েশন অব দ্য স্টাডি অব দ্য লিভারের পাবলিক হেলথ কমিটির চেয়ারম্যান মারিয়া বুটি বলেছেন, আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এখনও অনেক কম, কিন্তু এই রোগীরা শিশু। এটিই আমাদের প্রধান উদ্বেগের বিষয় এবং অন্যটি হল এর তীব্রতা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ