প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই পৃথিবীতে কীটপতঙ্গের বিচরণ। প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে কীটপতঙ্গের আগমন ঘটে। এরপর বড় একটা সময়জুড়ে পৃথিবীর প্রায় সব প্রতিবেশেই এদের আধিপত্য ছিল। ওইসময় কীটপতঙ্গ আকারেও বেশ বড় ছিল, এক একটি গঙ্গাফড়িং ছিল গাঙচিল পাখির সমান। কালক্রমে বিবর্তনের ধারায় পৃথবীতে আবির্ভূত হয় পাখি, সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণী। একসঙ্গে কমতে থাকে কীটপতঙ্গের প্রভাব।
তবে আকারে ছোট হয়ে গেলেও প্রজাতিবৈচিত্র্য ও সংখ্যাধিক্যে এদের জুড়ি নেই। বর্তমান সময়েও আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য প্রজাতির কীটপতঙ্গ। প্রাণিজগতে সবচেয়ে বেশি প্রজাতি আছে কীটপতঙ্গ শ্রেণীতে, পৃথিবীতে আবিষ্কৃত প্রাণিজগতের প্রায় ৮০ শতাংশই কীটপতঙ্গ।
ছোট পিঁপড়া থেকে শুরু করে ঘরের কোণের আরশোলা এবং বাহারি প্রজাপতি ও ঘাসফড়িং সবই কীটপতঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। মাটি থেকে শুরু করে গাছপালা, জলাশয়, ফসলের মাঠ এমনকি আমাদের বসতবাড়িতেও এদের দেখা যায়। কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীর বুকে বিচরণকারী এ প্রাণীগুলো হয়ে উঠেছে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। পরিবেশে বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের মাঝে যে আন্তঃসম্পর্ক ও খাদ্যজাল গড়ে উঠেছে তা কীটপতঙ্গ ছাড়া ভাবাই যায় না।
তবে বাড়ছে বিশ্বের তাপমাত্রা, সেই সঙ্গে মানুষের থাকার জায়গা আর খাবারের যোগান বাড়াতে গিয়ে বন উজাড় চলছে, চরমে পৌঁছাচ্ছে ভূমির ব্যবহার; সব মিলিয়ে পৃথিবীর অনেক এলাকায় কীটপতঙ্গের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলছে বলে উঠে এসেছে এক গবেষণায়।
সম্প্রতি নেচার জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে প্রথমবারের মত জলবায়ু সংকট এবং আধুনিক কৃষিকাজের মধ্যে স্পষ্ট ও উদ্বেগজনক এক যোগসূত্র প্রকাশ পেয়েছে।
ওই গবেষণার বরাতে সিএনএস জানিয়েছে, যেসব জায়গায় এই সংকট অনেক বেশি, সেখানে কীটপতঙ্গের পরিমাণ ৫০ শতাংশের মত কমে গেছে। আর কীটপতঙ্গের প্রজাতির সংখ্যা কমেছে ২৭ শতাংশ।
লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজের গবেষক এবং এ গবেষণা প্রবন্ধের প্রধান লেখক শার্লট আউটহোয়েইট বলছেন, স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রে পরাগায়ন এবং খাদ্য উৎপাদনে পোকামাকড়ের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, সেই বিবেচনায় গবেষণার এ ফলাফল বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ ঘটাচ্ছে।
তিনি বলেন, পোকামাকড় ধ্বংস হয়ে গেলে বা কমে গেলে জনস্বাস্থ্য এবং আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভ গলসন সিএনএনকে বলেছেন, আমাদের ফসলের তিন-চতুর্থাংশের উৎপাদন নির্ভর করে কীটপতঙ্গের ওপর। (কীটপতঙ্গ কমে গেলে) ফসল উৎপাদন কমা শুরু করবে। স্ট্রবেরির মত অনেক কিছুই তখন আর ফলবে না।
তিনি বলেন, পোকামাকড় যদি দুনিয়ায় না থাকে, তাহলে এই সাড়ে ৭০০ কোটি মানুষকে আমরা খাওয়াতেও পারব না।
পৃথিবীতে যদি পোকামাকড় না থাকে তবে খাদ্যাভাবে মরতে হবে মানবজাতিকে। সম্প্রতি বায়োলজিক্যাল কনজার্ভেশন জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, পোকামাকড়ের চল্লিশ শতাংশের বেশি প্রজাতি এখন হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। পাশাপাশি পোকামাকড়ের দশ শতাংশ প্রজাতি আগামী কয়েক দশকের মধ্যে হারিয়ে যাবে।
বছরে বিশ্বের ২৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ খাদ্য উৎপাদন পরাগায়নের উপর নির্ভরশীল। গমের মতো শষ্য পরাগায়নের জন্য বাতাসের উপর নির্ভরশীল হলেও অনেক খাদ্যশস্য আছে যেগুলো পরাগায়নের জন্য পোকামাকড়ের উপর নির্ভরশীল। ফলে তারা হারিয়ে গেলে কৃষকরা বিপাকে পড়বেন।
পরাগবাহী পোকামাকড় হারিয়ে গেলে অনেক শাকসবজি এবং ফলমূল উৎপাদন আর সম্ভব হবে না। ফলে আমাদের খাবার টেবিলে খাবারের পরিমাণ কমে আসবে। এমনকি চকলেট এবং কফির সংকটও দেখা দেবে।
গুবরে পোকার মতো অনেক পোকামাকড় মৃত গাছপালা, মরদেহ এবং মল পচতে সহায়তা করে। এই পোকামাকড় না থাকলে পচন প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘায়িত হবে, যা পরিবেশ এবং মানুষ – উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর হবে।
বিভিন্ন উভচর, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখির মূল খাবার পোকামাকড়। ফলে পোকামাকড় কমলে তাদের ওপর নির্ভরশীল প্রাণীও কমতে থাকবে।
আউটহোয়েইট সিএনএনকে বলেন, তাদের গবেষণায় কিছু অঞ্চলের পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত মেলেনি। ফলে প্রতিবেদনে যা এসেছে, প্রকৃত পরিস্থিতি হয়ত তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ।
আমার মনে হয়, এর আরও কিছু সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে, যদিও সেগুলো কী তা এখনও জানি না আমরা। এখানে অনেক ধরনের পোকামাকড় জড়িত। সেগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। কিছু বিষয়ে ওগুলোর ওপর আমরা এতটা নির্ভর করি যে, পরিস্থিতির ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।
ইউনিভার্সিটি অফ রিডিংয়ের ফলিত বাস্তুবিদ্যার অধ্যাপক টম অলিভার এক বিবৃতিতে বলেন, কীটপতঙ্গের সংখ্যা কমে যদি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, সেখান থেকে আর স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফেরা সম্ভব না, তাহলে ক্ষতি কতটা বড় হবে, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে কি না, বিজ্ঞানীরা এখনও জানেন না।
এখন যদি প্রশ্ন করা হয় যে কীটপতঙ্গের ঠিক কতটা ক্ষতি হলে সেটা পুরো বাস্তুতন্ত্র ধ্বসিয়ে দেবে, সত্যি কথা বলতে কি, আমরা সেটা এখনও জানি না।
টম অলিভার, যিনি এ গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না, বলেন, তবে আমরা এটা জানি যে, এটা কেবল কীটপতঙ্গের প্রজাতি ধ্বংসের মধ্যে থেমে থাকবে না। শেষ পর্যন্ত একটা বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনবে পারে।
বিষয়টিকে তিনি তুলনা করেছেন উড়ন্ত বিমান থেকে রিভেট খসে পড়ার সঙ্গে। কারণ সেটা চলতে থাকলে পুরো বিমানের অস্তিত্বই হুমকিতে পড়বে।
গবেষকরা বলছেন, কীটনাশক এবং রাসায়নিক সার ব্যবহার, ফসলের বৈচিত্র্য কমে যাওয়া, বিশাল মাঠজুড়ে ফসলের ক্ষেত, এক জায়গায় অনেক বেশি গবাদিপশু- এরকম যে বিষয়গুলো আধুনিক কৃষিকাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য, সেগুলোই কীটপতঙ্গ ধ্বংসে বড় ভূমিকা রাখছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু সংকটের সঙ্গে ভূমির অতি ব্যবহার মিলে বিপদ দ্বিগুণ করে তুলছে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে, যা স্থানীয় জলবায়ুকে নাটকীয়ভাবে বদলে দিতে পারে, তাপমাত্রাও অনেক বাড়িয়ে তুলতে পারে।
গবেষকরা বিশ্বের এমন অঞ্চলগুলোতে কীটপতঙ্গ কমে যাওয়ার প্রমাণ পেয়েছে, যে অঞ্চলগুলো অনেক বেশি উষ্ণ, বিশেষ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল। গবেষক আউটহোয়েইটের ভাষায়, কীটপতঙ্গের বৈচিত্র্যে সেসব এলাকায় যে মাত্রায় হ্রাসে পেয়েছে, সেটা উদ্বেগজনক।
এই গবেষকরা ৬ হাজার স্থানের ২০ বছরের বেশি সময়ের ডেটা বিশ্লেষণ করেছেন। প্রজাপতি, মথ, ড্রাগনফ্লাই, ফড়িং এবং মৌমাছিসহ কীটপতঙ্গের প্রায় ১৮ হাজার প্রজাতির ওপর পর্যবেক্ষণ চালিয়েছেন।
শেষমেশ যা পেয়েছেন, তা হল, আধুনিক কৃষির ব্যাপক প্রচলন হয়নি, এরকম এলাকায় কম উষ্ণায়ন ঘটছে। এসব এলাকার কাছাকাছি পোকামাকড়ের প্রাকৃতিক আবাস্থল পাওয়া গেছে।
আধুনিক পদ্ধতিতে আগ্রাসী চাষাবাদ শুরু হয়নি, আশপাশে কীটপতঙ্গের প্রাকৃতিক আবাস্থল আছে এবং উষ্ণায়ন কম হয়েছে, এরকম এলাকায় কীটপতঙ্গ কমেছে মাত্র ৭ শতাংশ। আর যেখানে ব্যাপক মাত্রায় আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু হয়েছে, উষ্ণায়ন বেশি হচ্ছে এবং পোকামাকড়ের প্রাকৃতিক আবাস্থল কমে গেছে, সেসব এলাকায় কীটপতঙ্গ কমেছে ৬৩ শতাংশ।
অনেক পোকামাকড় গরমের দিনে ছায়ার জন্য গাছের উপর নির্ভর করে। প্রাকৃতিক আবাসস্থলের ক্ষতি এগুলোকে আরও অরক্ষিত করে তোলে।
আউটহোয়েইট সিএনএনকে বলেন, এই সংকট থেকে বাঁচতে আরও দেশীয় প্রজাতির এবং উনো ফুলগাছ রোপণ করে, বাগানে কীটনাশক ব্যবহার কমিয়ে দিযে, এমনকি ঘনঘন ঘাস না কেটে আমরা ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেও ভূমিকা রাখতে পারি।
তারপরে অন্যান্য অঞ্চলে পোকামাকড় রক্ষায় আরও বিস্তৃতভাবে চিন্তা করা যায়। আমরা যে খাবারগুলো কিনছি, তার উৎস কোথায়, কীভাবে চাষ হচ্ছে, সেই প্রশ্ন যদি আমরা করি, সেটা সুফল দিতে পারে। যদি সেসব খাবার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলো থেকে সংগ্রহ করা হয়, সম্ভবত সেসব এলাকায় জীববৈচিত্র্যের ওপর উচ্চ প্রভাব পড়ছে।
আউটহোয়েইট বলেন, বাণিজ্য ও খাদ্য উৎপাদনের কী প্রভাব পরিবেশে পড়ছে, তা নির্ধারণে সরকারগুলোর একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। যেসব এলাকায় বন উজাড় করা হচ্ছে, সেখান থেকে খাদ্য আহরণের চেষ্টা থামাতে হবে।
জাতিসংঘের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, কীভাবে বিশ্বের বাস্তুতন্ত্রগুলো মানুষের জীবন যাপনের সঙ্গে খুব বেশি যুক্ত। যদি তাপ না কমে তাহলে এই গ্রহের জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে পোকামাকড়ের বড় ক্ষতি দেখতে থাকবে।
অলিভার বলেন, কীটপতঙ্গ কমে গেলে বাস্তুতন্ত্রের কার্যকারিতা ঠিকঠাক চালু থাকবে কি না, কিংবা শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই হারিয়ে যাবে কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও জানা নেই।
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এখনই আমাদের কাজ করা ভালো, যাতে আমাদের বাস্তুতন্ত্রের পতন দেখতে না হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১০
আপনার মতামত জানানঃ