ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের কারণে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি কমার পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে করোনা পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে নেমে এলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানিয়েছিল, ২০২২ সালে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও চীনে নতুন করে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে নিজেদের ভবিষ্যদ্বাণী থেকে সরে এসেছে আইএমএফ।
রয়টার্স জানিয়েছে, ইউক্রেইনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের কারণে মূল্যস্ফীতি এখন অনেক দেশের জন্যই ‘বিপদ’ হয়ে উঠেছে বলে হুঁশিয়ার করেছে আইএমএফ।
ফেব্রুয়ারির শেষার্ধে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযানের ঘোষণা দেন। এতে বিশ্ববাজারে দেখা দেয় বড় রকমের অস্থিরতা। এরই মধ্যে চীনে নতুন করে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে লকডাউনের মুখে পড়ে সাংহাই। অন্যদিকে যুদ্ধের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে দেখা দিয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। এ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটনভিত্তিক দেশ নেপাল ও শ্রীলঙ্কা চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে দিন পার করছে। এতসব ঝাক্কি-ঝামেলায় নিজেদের করা পুরোনো ভবিষ্যদ্বাণী ফিরিয়ে নিয়েছে আইএমএফ।
বছরের শুরুতে আইএমএফ বলেছিল, চলতি বছরে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে। তবে মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে প্রকাশিত নিজেদের এক প্রতিবেদনে আইএমএফ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৩ দশমিক ৬ শতাংশে নিয়ে আসে। এ ছাড়াও সামনের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে আইএমএফ প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ৩ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।
এ ছাড়াও সংস্থাটি বলছে, চলতি বছর উন্নত দেশগুলোতে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হারে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেবে। এ ছাড়াও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই মুদ্রাস্ফীতির হার হবে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে বাড়বে ভোগ্যপণ্যের দাম। দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে বলা হয়েছে, যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। রাশিয়ার জ্বালানি খাতের ওপর পশ্চিমা অবরোধ আরও বাড়ানো হলে বৈশ্বিক উৎপাদনে আরও একটি বড় ধস নামবে।
আর চীন আবারও কোভিড-১৯ এর কারণে লকডাউন ঘোষণা করেছে, এ বিষয়টিও আইএমএফের পূর্বাভাস কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
সংস্থাটি বলেছে, জ্বালানি, খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা ঝুঁকিতে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সামাজিক অস্থিরতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা মঙ্গলবার খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক এক প্যানেল আলোচনায় বলেন, ‘ইউক্রেইনে রাশিয়ার অভিযানের জন্য কতটা মূল্য চুকাতে হচ্ছে? একটা সংকটের ওপরে আরেকটি সংকট, তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে মানুষের প্রাণহানি এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ব্যাপক ধাক্কা’।
আইএমএফের হিসাবে এ বছর ইউক্রেইনের অর্থনীতি ৩৫ শতাংশ সঙ্কুচিত হবে, রাশিয়ার সঙ্কোচন হবে সাড়ে ৮ শতাংশ। আর এই দুই দেশসহ ইউরোপের অর্থনীতির সার্বিক সংকোচন হবে ২ দশমিক ৯ শতাংশ।
সংস্থার মুখ্য অর্থনীতিবিদ পিয়েরে-অলিভিয়ার গুরিনচেস এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানির বিরুদ্ধে পশ্চিমারা অবরোধ দিলে ২০২৩ সালে রাশিয়ার জিডিপির সঙ্কোচন দ্বিগুণ হয়ে যাবে, অর্থাৎ ১৭ শতাংশ সংকোচন হবে তাদের ডিজিপি প্রবৃদ্ধির হারে।
জ্বালানি, খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা ঝুঁকিতে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সামাজিক অস্থিরতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক এই আর্থিক সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, যুদ্ধের ফলে চলতি বছর ইউক্রেন ৩৫ শতাংশ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অন্যদিকে রাশিয়ার ক্ষেত্রে এই ক্ষতির পরিমাণ ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। মূলত পশ্চিমা দেশগুলোর দেওয়া বিরামহীন নিষেধাজ্ঞার ফলে সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে রাশিয়া।
তবে যুদ্ধ শুধু রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। পরোক্ষভাবে সমগ্র বিশ্ব এখন যুদ্ধের ফলাফল ভোগ করছে। ইউরোপে দেখা দিয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের দাম নিয়ে দিশেহারা সমগ্র বিশ্ব। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে ইতোমধ্যে লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুতে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির ভার সইতে না পেরে রাস্তায় নেমে এসেছে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের উল্লেখযোগ্য কিছু দেশ চলতি দশকের ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির মধ্য দিয়ে কালক্ষেপণ করছে।
অন্যান্য দিক থেকেও আইএমএফ তাদের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনছে। গত সপ্তাহে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিলিনা জর্জিয়েভা বলেছিলেন, ‘আমাদের ১৪৩টি সদস্যরাষ্ট্র বিশ্বের ৮৬ শতাংশ অর্থনীতির জোগান দিয়ে থাকে। তবে এবার আমরা লক্ষ্যমাত্রা কমাতে বাধ্য হচ্ছি। দেশীয় পণ্য উৎপাদনে এবার দেশগুলো পিছিয়ে থাকবে বলে মনে হচ্ছে।’
অলিভিয়ার বলেন, ‘আমরা শুধু করোনার আঘাত সামলে দাঁড়িয়েছি, এরই মধ্যে ইউরোপের যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়াটা বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় রকমের আঘাত।’ যুদ্ধে ইউরোপের দেশগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মহামারির মধ্যেও গত বছর যেখানে দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ৯ শতাংশ, সেখানে চলতি বছর যুদ্ধের প্রভাবে প্রবৃদ্ধি নেমে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৮ শতাংশে।
ফেডারেল রিজার্ভের কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থার ফলে বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব থেকে কিছুটা গা বাঁচিয়ে চলতে সক্ষম হবে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও যুদ্ধের শুরুতে চলতি বছর দেশটির আনুমানিক প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৪ শতাংশ, এখন তা কমিয়ে ৩ দশমিক ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
একইভাবে নতুন করে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও যুদ্ধের প্রভাবে চীনের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৪ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে আইএমএফ। তবে চীন সরকার জানিয়েছে, চলতি বছর তাদের লক্ষ্য ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা।
সামগ্রিকভাবে যুদ্ধের আগে আইএমএফ উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করেছিল ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। যুদ্ধ শুরু হলে এই হার পরিবর্তন করে ৩ দশমিক ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। একইভাবে উন্নয়নশীল অর্থনীতির প্রাক-যুদ্ধ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, যা বর্তমানে কমিয়ে ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
মার্চের শুরুর দিকে আইএমএফ জানিয়েছিল, যুদ্ধ শুধু ইউক্রেনেই সীমাবদ্ধ থাকবে ও মার্চের শেষের দিকে রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলোর একরকমের সমঝোতার সৃষ্টি হবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি যেকোনো দিকে মোড় নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে বিশ্ব ব্যাংকও পূর্বাভাসের চেয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমার ইঙ্গিত দিয়েছে। বর্তমানে এটি ধারণা করছে ২০২২ সালে বিশ্ব অর্থনীতি বাড়তে পারে তিন দশমিক দুই শতাংশ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৬
আপনার মতামত জানানঃ