২০১৯ সালে নেপালের প্রত্যন্ত একটি গ্রামে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরীকে ঋতুস্রাবের কারণে ছোট্ট বদ্ধ ঘরে আটকে রাখার পর দমবন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। ওই কিশোরীর নাম রোশানি তিরুয়া। সে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে ৪৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে আছাম জেলার গাজরা গ্রামের বাসিন্দা ছিল।
সম্প্রতি রোশনির ঋতুস্রাব শুরু হলে তাকে পাথর-মাটি দিয়ে তৈরি একটি ছোট্ট বদ্ধঘরে আটকে রাখা হয়। সূত্র মতে, শীত থেকে বাঁচতে বদ্ধঘরে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করলে ধোঁয়ায় দম আটকে মারা যায় রোশানি।
পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব নারীদের জীবনে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু, একথা মানতে নারাজ নেপালের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ। তাই ঋতুস্রাব চলমান অবস্থায় নারীকে দূরে কোথাও বা আবদ্ধ আলাদা কোনো ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। যা একরকম নির্বাসনের মতো।
নেপালের পশ্চিম এলাকায় ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন গ্রাম চৌপদীর হিন্দু অধিবাসীদের মাঝে শতাধিক বছর ধরে এই প্রথা প্রচলিত রয়েছে। এখানকার গ্রামগুলোর প্রায় সব পরিবারই এ প্রথা পালন করে।
স্থানীয় ভাষায়, এই প্রথাকে বলা হয় ছাউপাদি। দেশটিতে ২০০৫ সাল থেকে এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে বেআইনি ঘোষণা করা হলেও, এখনো অনেক সমাজে তা প্রচলিত।
এনডিটিভি জানায়, প্রথা অনুযায়ী নারীকে একই কাপড় পরে চারদিন ধরে কাটাতে হয়। ওই সময় কোনো পুরুষকে স্পর্শ করা যাবে না এবং বিশেষ কিছু খাবার খেতেও বারণ। এরপর ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম দিনে গরুর মূত্র দিয়ে গায়ে ছিটিয়ে তাদের ঘরে তোলা হয়। এতে ‘অপবিত্রতা’ দূর হল বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
ঋতুস্রাবের এ সময় নারীকে অপবিত্র বলে মনে করা হয়। তাই পরিবারের সঙ্গে রাখা হয় না। এমনকি পানির টিউবয়েল পর্যন্ত ধরতে দেওয়া হয় না। তাদের বিশ্বাস, এতে দেবতা অসন্তুষ্ট হবেন।
তবে দেশটির স্থানীয় নারী সমাজকর্মীরা এখন এ প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার। এখানকার পরিবারগুলোকে সচেতন করার চেষ্টা করছেন তারা। তারা অনুরোধ জানাচ্ছে, এ সময়টায় মেয়েকে বাড়ির বাইরে থাকতে বাধ্য করবেন না। তাদেরকে এ সময়টায় ঘরের ভেতর থাকতে দিন।
তবে সমাজকর্মীরা দেশটির গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এ খুবিই কঠিন কাজ। লোকজন তাদের সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়। অভিশাপও দেয়। বেশিরভাগ সময় পুলিশ সঙ্গে নিয়ে গ্রামগুলোতে ঢুকতে হয়।
২০০৫ সালে নেপালজুড়ে এই অমানবিক প্রথাটি অবৈধ ঘোষণা করে আইন জারি করা হলেও পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি গোত্রে এখনও প্রথাটি প্রচলিত।
জাতিসংঘসহ বিশ্বের সবগুলো আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা নারীর প্রতি এই নিষ্ঠুর আচরণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে আসছে।
অনেক পরিবার মেয়েদের এ সময়ে আলাদা একটি ঘরে রাখে। সেই ঘরগুলো সাধারণত মাটির। ঘরে প্রবেশের দরজা এতই ছোট যে হাতে-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে। কোনো কপাট নেই।
ওই নারীদের নিরাপত্তার জন্য শীতের সময় একটি মশারি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়। তবে অন্যসময় খোলাই থাকে। রাতে স্থানীয় নিরাপত্তা কর্মীরা টহল দেয় আর কুকুর ঘোরাফেরা করে। ফলে তাদের কাছে এটা নিরাপদ।
শহরাঞ্চলের মেয়েদের কাছে স্যানিটারি প্যাড পরিচিত হলেও, এখানকার মেয়েরা ঋতুস্রাবের সময় পুরনো কাপড় ব্যবহার করে। স্যানিটারি প্যাড কেনার মতো টাকাও তাদের নেই।
নেপালি নারী ধানা বিস্তা (৩২) কাঠমান্ডুতে থাকেন। ছেলেবেলা কেটেছে নেপালের পশ্চিমাঞ্চলে। সেখানে ছৌপাড়ি প্রথা কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। সংবাদ মাধ্যমের কাছে ধানা বলেন, ১২ বছর বয়সে প্রথমবারের মত পিরিয়ড হলে তাকে একটি ছোট কুঁড়েঘরে আটকে রাখা হয়।
কাঁদা ও খড়ের তৈরি কুঁড়েঘরটি এতোই ছোট ছিল যে, কোনরকম একজন মানুষ সেখানে ঢুকতে পারতো। ঘরের দরজা বন্ধ করা যেত না, মেঝেতে ছিল খড়, তাই শীতকালে ঠান্ডায় প্রচন্ড কষ্ট পেতেন তিনি। এ’কদিন ঘুমাতে ভীষণ অসুবিধা হতো তার। ধানা বলেন, তার পরিবারের সদস্যরা বিশ্বাস করতো, ছৌ্পাড়ি প্রথা না মানলে দেবতা অভিশাপ দেবেন।
২০০৫ সালে নেপালের সর্বোচ্চ আদালত ছৌপাড়ি প্রথা নিষিদ্ধ করেছেন। তারপরও এই প্রথা বন্ধ হয়নি। ২০১৭ সালে ছৌপাড়ি প্রথা মানতে গিয়ে সাপের কামড়ে ও ধোঁয়ায় দম আটকে ১০ মাসে ৩ মেয়ে মারা যান। তখন নেপাল সরকার এই প্রথা বন্ধ করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৩৩
আপনার মতামত জানানঃ