ওয়াসা ভবনের তিনতলা থেকে চেকগুলো দোতালায় জনতা ব্যাংকের শাখায় পৌঁছানোর পথেই উধাও হয়ে গেছে ১৩২ কোটি টাকা।
এখানেই শেষ নয়, ওয়াসা কর্মচারী সমবায় বহুমুখী সমিতির আগের সঞ্চিত তহবিল থেকে কমিটির অনুমোদন ছাড়াই অবৈধভাবে তুলে নেয়া হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, জনতা ব্যাংকের সাবেক শাখা প্রধান শ্যামল বিশ্বাসের সাথে ব্যাংক লেনদেনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়াসার কর্মচারী সমিতির অন্তর্বর্তীকালীন চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান ও মিজানুর রহমানসহ তখনকার কয়েকজন জড়িত এসব অনিয়মের সাথে।
আর সেই অনিয়ম ধামাচাপা দিতেই ব্যাংক ও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ টালবাহানা করছে ব্যাংক একাউন্ট বুঝিয়ে দিতে নতুন কমিটির কাছে।
যদিও এই বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি ব্যাংকের বর্তমান শাখা প্রধান ও অ্যাকাউন্ট পরিচালনাকারী সমিতির সাবেক চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান।
জনগণের বিশাল অংকের টাকা তসরুপ ঠেকাতে উদ্যোগ নেয়ার বদলে দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করার অভিযোগ রয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
২০২১ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির ১৩২ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা সামনে আসে। জেলা সমবায় অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে আসে। ওয়াসা প্রশাসনের ছত্রছায়ায় একটি চক্র এই টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে জানা যায়। শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান কমিটির কর্মকর্তারা এ অভিযোগ করেন।
সূত্র মতে, ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি ১৬ জুলাই ২০১৭ থেকে ৩০ জুন ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৯৯ কোটি ৬৫ লাখ ১৯ হাজার ১৭৩ টাকা ঢাকা ওয়াসা থেকে রাজস্ব আদায় কাজ বাবদ পায়। আর ২০১৮ থেকে ২০১৯ অর্থবছরে একই কাজ বাবদ সমিতি আয় করে ৩৪ কোটি ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯০ টাকা।
এর মধ্যে ২০১৭ থেকে ২০১৮ অর্থবছরে সমিতির হিসাবে জমা হয় ১ লাখ ৭৯ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৩ টাকা। অবশিষ্ট ১৩২ কোটি ৪ লাখ ১৭ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা জমা হয়নি। এ টাকা কোথায় গেল, সেটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে সে সময়।
ঢাকা ওয়াসার আশীর্বাদপুষ্ট কমিটির নেতারা এবং ঢাকা ওয়াসা প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে জানা যায়। সমবায় অধিদপ্তরের অডিট প্রতিবেদনে আর্থিক লুটপাটের চিত্র বেরিয়ে আসে।
সূত্র মতে, ৩০ এপ্রিল ২০১৯ সালে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ওয়াসার এমডির পক্ষ থেকে ইস্যু করা চিঠিতে বলা হয়, বহুমুখী সমবায় সমিতি ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি সংগঠন।
১৯৯৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা ওয়াসা রাজস্ব আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ দীর্ঘ সময় রাজস্ব আদায় কার্যক্রম পরিচালনাকালে সুনির্দিষ্ট চুক্তির আওতায় ঢাকা ওয়াসা থেকে বিপুল অর্থ কমিশন পেয়েছে সমিতি।
২০১০ থেকে ২০১১ অর্থবছর এবং ২০১৮ থেকে ২০১৯ অর্থবছর পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায়, ঢাকা ওয়াসা থেকে কর্মচারী সমবায় সমিতিকে ৪৪৫ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। এই অর্থ ব্যয়ের তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে ওই চিঠিতে। কিন্তু সমিতি থেকে সে তথ্য জানানো হয়নি।
এর আগে ২০২০ সালে পাওয়া গিয়েছিল আর এক ভয়াবহ অভিযোগ। জানা গিয়েছিল, বছরে মূল বেতন ৭০ কোটি টাকা হলেও, ওভারটাইম ৯৫ কোটি! অবিশ্বাস্য হলেও এটিই ঘটেছে ঢাকা ওয়াসায়।
শুধু তাই নয়, প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা কাগুজে রাজস্ব আয় দেখানো হয়েছিল। আর ২৫০ কোটি টাকার কেনাকাটার কোন কাগজপত্র মেলেনি। ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের জামানায় মোট সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার হদিসও পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকা ওয়াসায় স্থায়ী কর্মচারী ছাড়াও মাস্টার রোল ও আউট সোর্সিং এ অনেক জনবল কাজ করে। পাম্প পরিচালনসহ নানা কাজে নিয়োজিত থাকে তারা। এদের মধ্যে শুধু নিজস্ব অর্থাৎ স্থায়ী কর্মচারীরা ওভার টাইমের সুযোগ পান মূল বেতনের ঘণ্টা হিসেবে।
ওয়াসার হিসাব বলছে, বেতনের প্রায় দ্বিগুণ টাকা খচর হয়েছে ওভারটাইমে। ২০১৮ সালে এমডিসহ সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল বেতন ছিল ৭০ কোটি টাকা। বিপরীতে আড়াই হাজার কর্মচারীর নামে ওভারটাইম দেয়া হয়েছে ৯৫ কোটি টাকা!
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য আলি আহমদ গরমিলের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ওয়াসা যেভাবে কাজ করাচ্ছে তাতে তো বেতনের দরকার নেই। শুধু ওভারটাইমে কাজ করালেই তো হয়। এখানে বড় ধরণের গরমিল আছে। এটা অর্থের অপচয়।
ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের জামানায় অনিয়মের গল্প তার পদে থাকার মতোই বেশ লম্বা। ওই সময়েই ওয়াসার রাজস্ব আদায়ের হিসাবে বড় ধরণের অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এরমধ্যে শুধু রাজস্ব আয়ের নামে দেখানো ১ হাজার ১৮৩ কোটি টাকার হদিস নেই। অর্থাৎ শুধু কাগজেই রাজস্ব দেখিয়েছে ওয়াসা।
এসব বিষয় নিয়ে ওইসময়ে করা অডিটে কোনকিছুরই ভাউচার বা প্রমাণ দেখাতে পারেননি বলে জানান সাবেক অডিটর জেনারেল মাসুদ আহমদ। বলেন, অডিট চলাকালে যেসব বড় বড় আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে সন্দেহ মনে হয়, অডিটর ওইসবের হিসাব জিজ্ঞাসা করে। যেকোন হিসাবের ব্যাখ্যা কাগজের মাধ্যমে দিতে হবে; মুখে দিলে হবে না। কিন্তু স্টেশনে যিনি এখন আছেন তিনি এসব হিসাব গরমিলের আশানুরূপ কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। আর যেসব ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে একটার সাথে আরেকটার মিল নেই। তাই আপত্তি দেয়া হয়েছে।
২০১৮ সালে বিশাল অংকের অনিয়ম পাওয়ায় অডিটে আপত্তি তোলে অডিটর কোম্পানি হুদাভাসি। পানি বিক্রির আয় ৬৪৭ কোটি টাকা দেখানো হলেও তা ব্যাংকে জমা হয়নি, উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেয়া হয়।
অথচ এতো বড় অনিয়মে ব্যবস্থা তো দূরে থাক, বিষয়টি জানেনই না স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব হেলাললুদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার নলেজে নেই। আমাদের কাছে যদি প্রতিবেদন দেয়া হয়, তাহলে আমরা একটি কমিটি গঠন করে বিষয়টি খতিয়ে দেখব।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫১০
আপনার মতামত জানানঃ