যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনকে আরও ৮০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এবারের প্যাকেজে আর্টিলারি ব্যবস্থা, অর্টিলারি রাউন্ডস, সাঁজোয়া যান ও হেলিকপ্টার অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এ সামরিক সহায়তার কিছু চালান ইউক্রেনে আসতে শুরু করেছে। তবে ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়া বন্ধ না করলে ‘অপ্রত্যাশিত পরিণতি’ ভোগ করতে হবে বলে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছে রাশিয়া।
জানা গেছে, এবার ১৫৫ মিমি হাউইজারসহ বেশ কিছু অত্যাধুনিক অস্ত্র ইউক্রেনকে সরবরাহ করবে যুক্তরাষ্ট্র, যা যুদ্ধে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলা ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ অন্যদেশের জন্য খারাপ নজির স্থাপন করবে।
মার্চের শেষ দিকে ইস্তাম্বুলে প্রেসিডেন্ট রিসেফ তায়েপ এরদোয়ানের হস্তক্ষেপে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সেময় কিয়েভ থেকে সামরিক কার্যক্রম কমিয়ে আনার ব্যাপারে ইতিবাচক বার্তা দেয় রাশিয়া।
তাছাড়া ইউক্রেনের সমর্থনে পাঠানো সরবরাহ ব্যবস্থায় হামলার বিরুদ্ধে মস্কোকে সতর্ক করেন ন্যাটোর প্রধান জেন স্টলটেনবার্গ। তারপর এসব ক্ষেত্রে হামলা থেকে বিরত থাকে রাশিয়া। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ বাড়িয়েছে।
রাশিয়া তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে ইউক্রেনের সেনাদের ভারী অস্ত্র থেকে বিরত রাখতে হামলা চালাতে পারে। ফলে সংকট আরও বাড়বে। ইউক্রেনকে দেওয়া সামরিক সহায়তার ফলে পরবর্তী শান্তি আলোচনাও এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।
জেলেনস্কি সরকারকে সরবরাহ করা যুক্তরাষ্ট্রের ভারী অস্ত্র শুধু শান্তি আলোচনার অগ্রগতিকেই নষ্ট করবে না, সংঘাতকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করবে। যদিও ওয়াশিংটন এমনটাই প্রত্যাশা করছে। এদিকে রাশিয়া চায় সীমিত পরিসরে তাদের কার্যক্রম চালাতে ও শান্তি আলোচনার মাধ্যমে বিতর্ক নিরসন করতে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো চায়, এই যুদ্ধকে ব্যবহার করে মস্কোকে ফাঁদে ফেলতে। যা দীর্ঘমেয়াদে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচন করতে পারে। একদিকে ইউক্রেনকে দেওয়া অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে অনিচ্ছুক, অন্যদিকে ন্যাটোকেও থামাতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরিতে দেশটি এ পন্থা হাতে নিয়েছে।
পশ্চিমারা ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভাড়াটে যোদ্ধা পাঠিয়েছে এমন দাবিকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া রাশিয়ার সম্প্রতি ডুবে যাওয়া জাহাজটির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের হাত রয়েছে এটাও নাকচ করে দেওয়া যায় না। এর ফলে রাশিয়াও প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হতে পারে। সামরিক সংঘাত হতে পারে দীর্ঘায়িত।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সতর্কতার পরও পেন্টাগন জানিয়েছে, ইউক্রেনে তাদের সামরিক সহায়তা অব্যাহত থাকবে। মস্কোর সতর্কতার বিষয়টি অবহেলার মানে দাঁড়ায় এ সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে রাশিয়াকে ধ্বংস করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
এ জন্য তারা স্বল্পমেয়াদে যুদ্ধ বিরতিও চায় না। রাশিয়ার উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করা ও সামরিক সক্ষমতাকে দুর্বল করতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সংঘাতে জড়াচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে পশ্চিমাদের সরবরাহ ব্যবস্থাকে লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করতে পারে রাশিয়া। এমন সিদ্ধান্তের ফলে ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে সংঘাত অবধারিত হতে পারে। এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি যেভাবে অবনতি হচ্ছে তাতে পারমাণবিক যুদ্ধও ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা মানবতার জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। যদিও কেউই এমন পরিস্থিতি দেখতে চাই না।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। তবে দূরে থেকে মিত্র ইউক্রেনকে একের পর এক অস্ত্র সহায়তা দেয় দেশটি। আর অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়াকে কাবু করতে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ফায়দা কি কেবল অস্ত্র বেচে! নাকি যুদ্ধ দেশটিকে আরও অনেকভাবে সহায়তা করছে!
২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদালয়ের এক গবেষক বলেছিলেন, ‘ইউক্রেনে অস্ত্র বিক্রি আগুনে কেরোসিন ঢালার সমতুল্য।’ আন্তর্জাতিক গবেষক-বিশ্লেষকদের বারবার আপত্তি সত্ত্বেও ইউক্রেনে অস্ত্র বিক্রি কেবল অব্যাহতই নয়, বাড়িয়েও দেয় যুক্তরাষ্ট্র। কারণ যুদ্ধ-সংঘাত লাভজনক ব্যবসা। এটি অস্ত্র প্রস্তুতকারক ও ঠিকাদারদের হাতে কোটি কোটি ডলার মুনাফা এনে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম প্রতিরক্ষা ঠিকাদার ও অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। আর রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ হলেও অস্ত্র সরবরাহের পরিমাণের দিক থেকে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের এক-তৃতীয়াংশ।
সুইডেনভিত্তিক সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ২৫টি কোম্পানি বিভিন্ন দেশে ৩৬১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে। ওই কোম্পানিগুলোর মধ্যে শীর্ষ পাঁচটি কোম্পানিই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। এগুলো হচ্ছে লকহিড মার্টিন, বোয়িং, নর্থরপ গ্রুম্ম্যান, রেথিওন ও জেনারেল ডায়নামিকস।
এই পাঁচ কোম্পানি ২০১৯ সালে এক বছরেই ১৬৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করেছিল। ২০১৮ সালে ইউক্রেনে ট্যাঙ্কবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাতে লকহিড মার্টিনের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সামরিক সংঘাত অস্ত্র উৎপাদনের অর্থনীতি সচল রাখে। অস্ত্র বিক্রির অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে দশকের পর দশক ধরে চাঙ্গা করে আসছে। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে টানা দুই বছর বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যায় মার্কিন অর্থনীতি। বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু এই দুই দিক থেকে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মহামারীর সময় বেকার হয় লাখ লাখ মার্কিন নাগরিক। কঠোর লকডাউনে স্থবির হয়ে পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে হিমশিম খান যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের কোথাও যুদ্ধ লাগলে তা যে যুক্তরাষ্ট্রকে তার অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, তা বলাই বাহুল্য। ইউক্রেনে অস্ত্র বিক্রি অব্যাহত রাখলে পুতিন ক্ষিপ্ত হয়ে যুদ্ধের ডাক দিতে পারেন ভূ-কৌশলগত বিশ্লেষকদের এই সতর্কবার্তা তাই কানে তোলার খুব একটা দরকার ছিল না যুক্তরাষ্ট্রের।
প্রধানত জাতীয়তাবাদী চেতনা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একের পর এক প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে উদ্বুদ্ধ করে রাজনীতি, প্রশাসন ও কূটনীতিতে অনভিজ্ঞ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে। সামরিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউক্রেনের ঘনিষ্ঠতায় আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। তার ওপর জেলেনস্কির ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার তৎপরতা তাকে আরও ক্ষিপ্ত করে তোলে। পুতিনের আগ্রাসী তৎপরতা থামানো ও তাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য অনেক নেতা বললেও শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে যেতে রাজি হননি বাইডেন।
ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ ও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দায়িত্ব সারেন তিনি। এমনকি রাশিয়া পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দিলেও বাইডেন তার অবস্থান থেকে সরে আসেননি। যুক্তরাষ্ট্র চায় তার অস্ত্র প্রস্তুতকারক কোম্পানি ও ন্যাটোভুক্ত মিত্র দেশগুলো ইউক্রেনে অস্ত্র বিক্রি অব্যাহত রাখুক।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮১০
আপনার মতামত জানানঃ