রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ কার্যকরে আরেক ধাপ অগ্রসরতা দেখা যাচ্ছে। বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি ইতোমধ্যে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলেছে। ঢাকা শহরের গণপরিবহনকে প্রতিযোগিতামুক্ত ও নিয়মানুগ করতে ৪২টি রুট ও এসব রুটে বাস পরিচলানার জন্য ২২টি বাস কম্পানিই যথেষ্ট মনে করছে কমিটি। চূড়ান্ত হওয়া প্রস্তাবিত ৪২ রুটের মধ্যে একটী পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হবে আগামী বছরের ১ এপ্রিল থেকে। প্রথম ধাপে ঘাটারচর-মতিঝিল রুটে পাইলট আকারে ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবস্থাপনা চালু করা হবে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য রুটও এ পদ্ধতির আওতায় আসবে।
জানা যায়, ঢাকায় চলমান বাসগুলোর মালিক দুই হাজারের বেশি। আর ঢাকা ও আশপাশে ২০০–এর বেশি রুটে বাস চলাচল করে। যাত্রী তোলার জন্য এক বাসের চালক অন্য বাসের সঙ্গে পাল্লায় লিপ্ত হন। এর ফলে দুর্ঘটনা বাড়ে। এই ব্যবস্থা পরিবর্তনে ২০০৪ সালে ঢাকার জন্য করা ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনায় ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ বা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ চালু করার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিশেষ এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হচ্ছে লক্কড়ঝক্কড় বাস তুলে নেওয়া। সহজ শর্তের ঋণে নতুন বাস নামানো। বাস চলবে ৫-৬টি কোম্পানির অধীনে। মালিকেরা বিনিয়োগের হার অনুসারে লভ্যাংশ পাবেন।
৮ ডিসেম্বর ২০২০, গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নগর ভবনে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির বৈঠকে রুট ও বাস বিষয়ক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। বৈঠক শেষে মেয়র তাপস বলেন, বিভিন্ন বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাস রুট রেশনালাইজেশন সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে ৯টি ক্লাস্টারে ২২টি কোম্পানি ও ৪২টি রুটের যে প্রস্তাবনা এসেছে, সেটিকেই চূড়ান্ত করা হয়েছে। তারই আলোকে প্রাথমিকভাবে একটি রুটের আংশিক ঘাটারচর থেকে মতিঝিল অংশে পাইলটিং হিসেবে ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবস্থা চালু হবে।
মেয়র বলেন, ঘাটারচর-মতিঝিল রুটে ১৬৫টি বাস চলবে। মালিকপক্ষ পরবর্তী সভার আগের এই সময়সীমার মধ্যে কোম্পানি গঠনের জন্য একটি জয়েন্টভেঞ্চার এগ্রিমেন্ট করবে। এ সময় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের দুই মেয়রেরই যানজটমুক্ত ঢাকা শহর উপহার দেওয়ার ওয়াদা ছিল। বৈঠকে এসব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কার কী দায়িত্ব, সেটি নিয়েও আলাপ হয়েছে। আশা করছি, অচিরেই গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
বৈঠকে কমিটির সদস্য ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম, বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার, বিআরটিসির চেয়ারম্যান এহসানে এলাহী, বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সদস্য সচিব ও ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রাকিবুর রহমান, ডিএনসিসির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আরিফুর রহমান, গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এসএম সালেহ উদ্দীন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আজমাল উদ্দিন আহমদ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
“বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ” বলতে নগর অঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট বাস রুটে একটি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তিবদ্ধ বাস সার্ভিসকে বোঝানো হয়। বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল আরও চার বছর আগে। কিন্তু এখনো প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। সরকারের পক্ষ থেকে এখন আবার নতুন করে আশার বাণী শোনানো হচ্ছে আগামী এপ্রিলকে সামনে রেখে। কিন্তু আগে কেন কাজ হয়নি, এতদিন ধরে কেন বিষয়টি ঝুলে আছে, সেই প্রশ্নের উত্তর নেই। আবারো যে এই প্রকল্প ঝুলে যাবে না, সে বিষয়ে তাই নগরবাসী ও নগরবিদদের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে।
জানা যায়, ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় নতুন ৪ হাজার বাস নামানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। তিনি মারা যাওয়ার পর দায়িত্ব বর্তায় ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের ওপর। এরপর তাঁর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ১১টি সভা করে। সাঈদ খোকনের বিদায়ের পর তার জায়গায় দায়িত্ব পান বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। নতুন মেয়র দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন, নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হবে। সেই যাত্রার গতি কি আগের মতোই হবে কিনা তা অবশ্য তিনি খোলাসা করেননি।
বর্তমান উদ্যোগ যে সফলতার মুখ দেখবে, তার নিশ্চয়তা কী? এমন প্রশ্নের জবাবে মেয়র তাপস বলেন, এর আগের সভাগুলোতে অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সেই সিদ্ধান্তগুলো এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। বাসের বিশেষ ব্যবস্থা চালুর কর্মপরিকল্পনা ঠিক করার জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়েছে। তবে সেই প্রতিবেদনের আলোকে পরবর্তী সময়ে আর কোনো কার্যক্রম নেওয়া হয়নি। এ জন্য আমরা নতুন করে শুরু করেছি এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই কমিটিতে মেয়র ছাড়া বাকি সবাই আগে থেকেই আছেন। ফলে কাজে কোনো বেগ পেতে হচ্ছে না। আমরা এটা পরিষ্কার করেছি যে সিদ্ধান্ত সবাই মিলে বাস্তবায়ন করতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে সরকারকে জানাব যে এই কমিটির আর প্রয়োজন নেই।’
কমিটির সদস্য ও ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলামও সাংবাদিকদের এ প্রসঙ্গে এর আগে জানিয়েছেন যে, ‘এত দিন কেন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি, সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এখন থেকে ভালোভাবে কাজ হবে।’
ফ্র্যাঞ্চাইজ পদ্ধতিকে শুরু থেকে স্বাগত জানিয়েছেন রাজধানীর মানুষ। কিন্তু এতদিন ধরে এই প্রকল্প ঝুলে থাকায় হতাশা তৈরি হয়েছিল। এখন নতুন করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়া ও দ্রুত পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দুই মেয়র। মেয়রদ্বয়ের এমন আশাবাদে আস্থা রাখতে চান ঢাকাবাসী।
এসডাব্লিউ/এসএন/আরা/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ