ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দরনগরী মারিউপোল শহরে এক হাজারের বেশি ইউক্রেনীয় সেনা রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
প্রসঙ্গত, ইউক্রেনের মারিউপোলে ৪৮ দিন ধরে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করছে ইউক্রেনের সেনারা। তবে এই বন্দর শহরটিতে থাকা ইউক্রেনের সেনারা এখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বেশি কিছুদিন যাবৎ। তাদের কাছে কোনো সামরিক সহায়তা আসেনি। সঙ্গে আসেনি খাবারও।
কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই শহরটি রুশ সেনারা এক মাসেরও বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ করে রাখার পর ইউক্রেনীয় সেনারা আত্মসমর্পণ করল।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে আজ বুধবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম এএফপি। এর আগে রাশিয়ার হাতে অবরুদ্ধ থাকার কারণে দক্ষিণাঞ্চলীয় এই বন্দরনগরীতে ব্যাপক মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে জানানো হয়েছিল।
প্রকাশিত বিবৃতিতে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মারিউপোল শহরে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর ৩৬তম মেরিন ব্রিগেডের ১ হাজার ২৬ জন সেনাসদস্য স্বেচ্ছায় তাদের অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করেছে।
আত্মসমর্পণকারী সেনার মধ্যে রয়েছেন ১৬২ জন সেনা কর্মকর্তা, তার মধ্যে ৪৭ জন মহিলা। তার আগে দুই বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে শতাধিক আহত হয়েছেন বলেও জানিয়েছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
যুদ্ধে রাশিয়ার প্রধান টার্গেটই ছিল ডনবাস অঞ্চল দখলে নেয়া। এই অঞ্চলের প্রধান শহর মারিউপোলে ইউক্রেনের সেনাদের আত্মসমর্পণ রাশিয়ার জন্য বড় সফলতা।
রাশিয়ার দাবি অনুযায়ী, শহরের আজোভস্তাল শিল্প এলাকা থেকে ওই সেনারা আত্মসমর্পণ করেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, এ দাবি সত্যি হলে মারিউপোল কার্যত এখন রাশিয়ার দখলেই রয়েছে।
এই শহর দখল হলে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা পূর্ব ইউক্রেনের সকল এলাকার মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হবে। এতে করে রাশিয়া যদি আবারও ইউক্রেনের অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালনা করতে চায় তাহলে আগের বারের মতো যোগাযোগ ও সরবরাহ সংকটে পড়তে হবে না দেশটিকে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়ান সেনারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে ইউক্রেনে এই হামলা শুরু করে।
একসঙ্গে তিন দিক দিয়ে হওয়া এই হামলায় ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে বৃষ্টির মতো।
উল্লেখ্য, প্রায় পাঁচ লাখ বাসিন্দার মারিউপোল শহরটি দখল করা রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এই শহরটি আজভ সাগরে ইউক্রেনের কৌশলগত বন্দর এবং ডনবাস অঞ্চলে রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোর কাছেই অবস্থিত।
গণমাধ্যম বিবিসি জানায়, আত্মসমর্পণের আগে মারিউপোলে যুদ্ধরত এইডিন আসলিন নামে এক ব্রিটিশ-ইউক্রেনীয় সেনা তার মায়ের কাছে ফোন দিয়ে বলেছে, মা আমরা (পুরো একটি সেনা ইউনিট) রুশ সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করছি। আমাদের গোলাবারুদ ও খাবার দুটিই ফুরিয়ে গেছে।
ওই সেনার মা বিবিসিকে জানিয়েছেন, তার ছেলে জানিয়েছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাদের কাছে বিকল্প কোনো রাস্তা নেই।
এ ব্যাপারে ওই সেনার মা বলেন, সে আমাকে ফোন করে বলেছে, লড়াই করার মতো কোনো অস্ত্র আর তাদের কাছে নেই।আমি আমার ছেলেকে ভালোবাসি।সে আমার হিরো।তারা কঠোর যুদ্ধ করেছে। তবে সে ভালো আছে।
গত মার্চ মাসের শেষের দিকে মারিউপোলের শহর কাউন্সিল জানিয়েছিল, রুশ সামরিক অভিযানের কারণে ১ লাখ ৪০ হাজার বেসামরিক মানুষ পালাতে সক্ষম হলেও আরো ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষ শহরটিতে আটকা পড়েছেন।
এর আগে রাশিয়ার হামলায় বিধ্বস্ত বন্দরনগর মারিউপোলে ইউক্রেনের সেনাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয় রুশ সেনাবাহিনী। তবে এ নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে ইউক্রেন জানিয়েছিল, তারা লড়াই চালিয়ে যাবে।
এ সময় মারিউপোলে অবস্থান করা ইউক্রেনের সেনাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিফেন্স ম্যানেজমেন্টের পরিচালক কর্নেল জেনারেল মিখাইল মিজিন্তসেভ বলেন, ‘আপনারা অস্ত্র সমর্পণ করেন। যারা অস্ত্র সমর্পণ করবেন, তাদের নিরাপদে মারিউপোল শহর ছেড়ে যেতে দেওয়া হবে।’
ওই সময় ইউক্রেনের উপপ্রধানমন্ত্রী ইরিনা ভেরেশ্চাক জানান, মারিউপোলে আত্মসমর্পণ বা অস্ত্র সমর্পণের কোনো প্রশ্নই আসে না। রাশিয়াকে বিষয়টি আগেই জানানো হয়েছে।
গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এরপরে এখনো বড় কোনো শহর দখল করতে পারেনি রাশিয়া। মারিউপোল দখল হবে দেশটির জন্য প্রথম কোনো বড় সফলতা। অভিযানের প্রথম থেকেই এটি দখলের চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশটি।
তবে গত দুই সপ্তাহে রাশিয়া সমগ্র ইউক্রেন বাদ দিয়ে শুধু পূর্ব ইউক্রেনকে টার্গেট করে অভিযান পরিচালনা করে চলেছে। ফলে মারিউপোলের পতন শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, দ্রুতই সমগ্র মারিউপোল রুশ নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, এক মাসের বেশি সময় ধরে রুশ সেনাদের অনবরত হামলায় কৌশলগত এই শহরটি কার্যত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। ফলে শহরে আটকে পড়া আতঙ্কিত বেসামরিক বাসিন্দাদের অনেকে ভূগর্ভস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। একইসঙ্গে শহরে পানি, খাবার এবং ওষুধের মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলেও সেসময় জানানো হয়েছিল
এসডব্লিউ/এসএস/১৭২৫
আপনার মতামত জানানঃ